মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চারণ করে ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গুলশান জগার্স সোসাইটির প্রধান উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নূর আলী বলেছেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর কথা শুনেছি। প্রতি বছরই বলে যাচ্ছি। আমরা কতটুকু মনে ধারণ করছি তার আদর্শকে? আজও ৭১ এর শহীদদের ব্যাথা বেদনা মনের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু তাদের কথা আমরা মুখে না বলে অন্তরে ধারণ করে যদি চলতে পারি; তাহলে আমাদের দেশে দুর্নীতি কমে যাবে। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বে লিডার একজনই ছিলেন, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। আর যারা ছিলেন বা বর্তমানেও আছেন এরা হলেন নেতা।’
বিজয় দিবস উপলক্ষে শুক্রবার জগার্স সোসাইটি আয়োজিত আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চারণ করে তিনি এ কথা বলেন।
লিডার আর নেতার পার্থক্য তুলে ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর আলী বলেন, ‘হয়তো বলবেন নেতা আর লিডারের মধ্যে পার্থক্য কি? নেতারা চিন্তা করেন সামনে নির্বাচন, পাস করতে হবে। দেশ শাসন করতে হবে। ক্ষমতায় যেতে হবে। সে সরকারি দলের হোক বা বিরোধী দলের হোক। আর লিডার চিন্তা করে জাতির জন্য, দেশের জন্য, প্রজন্মের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য। যেটা বঙ্গবন্ধু করে গেছেন। বাঙালি জাতিকে এ দেশ দিয়ে গেছেন। ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়েছেন। তিনিই হলেন লিডার।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের ৪টি স্তম্ভ দিয়ে গেছেন। গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। আর কে বলেছেন? ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে একটি মানুষ দেখান। স্বাধীনতার কথা কে বলেছেন? স্বাধীনতার জন্য মানুষকে ধাপে ধাপে কে তৈরি করেছেন? একমাত্র বঙ্গবন্ধুই। আজকে তাকে নিয়ে যখন বিতর্ক হয় তখন আমার ঘৃণা লাগে। মানুষ পক্ষে বিপক্ষে থাকতেই পারে। কিন্তু সত্যকে সত্য বলা এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সাহস দিতে হবে। সেই হবে প্রকৃত মানুষ যে সত্যকে সত্য বলতে পারবে, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারে।’
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নূর আলী বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। কেউ আরবি শেখে, কেউ ইংরেজি শেখে। আরবি যে শেখে সে ইংরেজি শিক্ষাকে বলে নাস্তিকতা। আর ইংরেজি যে শেখে সে বলে আরবিকে বলে ক্ষ্যাত। একটা দেশে গত ৫১ বছর ধরে এ অবস্থা চলতে পারে না। আমাদের অনেক অর্জন আছে কিন্তু কিছু সমালোচনার জায়গাও আছে। যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে ৫ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা এই দেশে থাকত না। গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা এক রকম আর শহরের এক রকম। যারা ইংরেজি শেখে তাদের আমরা সম্পদ বলি। তবে আজকের গ্লোবাল বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজির দরকার আছে। কিন্তু সেই ইংরেজি শিক্ষার সন্তানগুলো কোথায়? তারা চলে যাচ্ছে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। আমাদের এ শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করা দরকার।’
এ সময় উপস্থিত সকলের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষকের সন্তান। আমরা শ্রমিকের সন্তান। আমাদের মা-বাবা স্কুলে পাঠিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। আমরা সুশিক্ষা নিয়ে এই জায়গায় আসার চেষ্টা করেছি। আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আজকে আমরা ধাপে ধাপে এই জায়গায় এসেছি। বঙ্গবন্ধুর বদৌলতে স্বাধীনতা পেয়েছি। ১৯৭১ সালের আগে বাঙালি কোন দিনই স্বাধীন ছিল না। ৬ হাজার বছর আগে পালেরা শাসান করত, তারা বাঙালি ছিল না। সেনরা শাসন করত তারাও বাঙালি ছিল না। এরপর মধ্যযুগের শাসকরা শাসন করত, তারাও বাঙালি ছিল না। মোঘলরা কোন দিনই বাঙালি ছিল না। ফ্রান্স, পুর্তগিজ তারাও বাঙালি ছিল না। ব্রিটিশরাও বাঙালি ছিল না। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর লিডারশীপে ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ তিনি যখন স্বাধীনতার ঘোষণা ইপিআর এর মাধ্যমে লিখে দিলেন; তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস। সে দিন থেকেই আমরা স্বাধীন। ভালো মন্দ মিলে শাসন করে যাচ্ছি। আমাদের সব থেকে দুর্বলতা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি। মানুষের দুইটা হাত কিন্তু এখন আমাদের তিনটা হাত। একটা হাত কেটে ফেলতে হবে। সেটা হলো অযুহাত, দুর্নীতির হাত। এই হাতকে যদি কাঁটতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারব।’
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, ‘সরকারের সমালোচনা অবশ্যই করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করবেন। সমালোচনা করতে হলেও শালীনতাবোধ থাকতে হবে। আজকে রাজনীতিকে সম্মান দিতে চায় না। রাজনীতি করলেও তো আমরা সমাজের মানুষ। রাজনীতিবিদদের প্রত্যেকের সমাজে একটা অবস্থান আছে। এটা মাথায় রেখেই সমালোচনা করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘এক সময় ভাবতাম সিএসপিদের ছাড়া দেশ চালানো যাবে না। তারাই একমাত্র কৃতি সন্তান। কিন্তু আজকে ৫১ বছরে দেখছি; গ্রাম-গঞ্জ থেকে উঠে আসা সন্তানরাও বিসিএস দিয়ে প্রশাসন চালাচ্ছেন। যোগ্যতার সাথেই চালাচ্ছেন। সেখানে শুধু পুরুষ না, মেয়েরাও আছেন। তবে স্বাধীনতার ৫১ বছরে শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছুটা গলদ আছে। শিক্ষাকে কাঙ্খিত জায়গায় আনতে পারিনি। এখন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে চলছে। আমরা মনে করি একদিন এখান থেকে বেরিয়ে আসবো। আমাদের তরুণ প্রজন্ম থেকে এই সমাজ থেকে একটা পরামর্শ আসবে। তখন থেকেই বেরিয়ে আসবে শিক্ষা ব্যবস্থার সমাধান।’
শিল্পমন্ত্রী বলেন, ‘বড় লোকেরা অনেকেই দেশের বাহিরে ঘোরেন। এখন কিন্তু দেশেও ঘুরার মতো জায়গা তৈরী হয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ পর্যটন আছে। আপনারা যদি বাংলাদেশটা একটু ঘুরেন তাহলে নেতিবাচক প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে যাবেন। বড় বড় শিল্পপতিরা বোয়াল মাছের মতো, গজার মাছের মতো ছোট মাছ খেয়ে ফেলে। প্রাণ সবই বানাবে। মুড়ি-মোয়া, চিড়া সেগুলো প্রাণ প্যাকেট করে বিক্রি করে। তাহলে আমাদের ক্ষুদ্র শিল্প টিকবে কিভাবে?’
তিনি বলেন, ‘সুশানের জায়গায় এখনও কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছতে পারিনি। তবে আমরা মনে করি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই চেতনার বিকাশ হওয়া দরকার। এটা করতে পারলে রাজনৈতিক বিভাজন কমে আসবে। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে অত্যান্ত সোচ্চারভাবে কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন শিক্ষিতরাই দুর্নীতি করেন। আমরা যদি জ্ঞানপাপী না হই, নিজেকে নিজে যদি ধোঁকা না দেই তাহলে সমাজটা ঠিক হয়ে যাবে। আমরাই বিভাজনের সৃষ্টি করি নিজের স্বার্থে।’
নূরুল মজিদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না, কেউ পারেনি। ষড়যন্ত্র এখনও চলছে, তখনও চলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় চলেছিল। আমাদের আপোষ করার জন্য অনেক কথা হয়েছে; কিন্তু আমাদের কেউ আপোষ করেনি।’
ব্যাংক ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের মালিক করা? উচ্চবিত্তরাই কিন্তু ব্যাংকের মালিক। শালা, দুলাভাই, স্ত্রী মিলেই একটা ব্যাংক করে। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক লুট করে এই ব্যাংকগুলো তৈরি করে। আমাদের যদি সম্পদের হিসাব টান দেই কেউ রক্ষা পাবে না। হিসাব চান? হিসাব দিতে পারি জিরো টলারেন্সে। তখন কিন্তু দৌঁড়াদৌঁড়ি লাগবে। দেশ থেকে পালিয়ে যাবে অনেকেই। সত্যকে সত্য বলা যায় না। আমরা বলতে চাই না। আপনাদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকি। আমরা বুঝি না, তা না। প্রধানমন্ত্রী বুঝেন না, তা না। সব টান দিলে তো ভেসে আসবে। আমরাও বাঁচি আপনারাও বাঁচেন। দেশটাও বাঁচুক। নিজেরা আত্মশুদ্ধির পেয়ে গেলে সমাজ শুদ্ধি হয়ে যাবে। শুদ্ধি অভিযানের দরকার হবে না।’
তিনি বলেন, ‘দেশে মিলিটারি শাসনের দরকার নাই। সামরিক শাসন কেন আনি? তারা এলে পাছায় বেত দেয়। যারে খুশি চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। তখন আমাদের অপমান লাগে না। যখনই গণতন্ত্র চর্চা করি তখন খুব অপমানিত হই। পুলিশ এই করেছে, সেই করেছে। পুলিশের জায়গায় একটা সিপাই দেই তখন তো বাড়িতেই থাকবে না কেউ। পুলিশ মানুষের সাথে চলে, তারা সমাজকে ধারণ করে। আমাদের উদ্দেশে কি? উন্নয়নকে কেন বাধাগ্রস্ত করব। ভুল সবারই থাকে। নির্বাচন হবে। জনগণ ভোট দেবে। সরকারের পরিবর্তন হবে। এই প্র্যাকটিস করি না। বিদেশীদের কাছে দৌঁড়াদৌড়ি ছাড়ি না। আর কত গোলামি? স্বাধীন হয়েছি। আমরা তো মনে করি এখনও স্বাধীন না। আমরা তো আবার পরক্ষভাবে তাদেরকেই, আমাদের যে বেনিয়ারা শাসন করেছে তাদের কাছেই যাচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদি শক্তির কাছেই আমরা যাচ্ছি। তাদের পদলেহন করছি। আমরা বলি আমরা স্বাধীন জাতি। স্বাধীনতা রইল কোথায়?
গুলশান জগার্স সোসাইটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন গুলশান জগার্স সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল্লাহ। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন, সহ-সভাপতি এম এ কামাল, প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন, হুশনিয়ারা আহসান প্রমুখ।
প্রতিবারের ন্যায় এবারো গুলশান জগার্স সোসাইটি, জগার্স প্রাঙ্গনে মহান বিজয় দিবস উদযাপন করে। বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি প্রদর্শন করা হয়। আলোচনা শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন অতিথিরা। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় পতাকা ও জগার্স সোসাইটির পতাকা উত্তোলন করা হয়।