২০২২ ছিলো প্রত্যাবর্তন আর অর্থনীতি পুনর্গঠনের বছর। শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগ কোভিড-১৯ সৃষ্ট সমস্ত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, আমরা প্রমাণ করেছি, সকল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার সক্ষমতা আমাদের আছে, এবং সকল প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।
আমরা একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। কারণ, আমরা অর্থনীতি এখনও মহামারির সংকট থেকে পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি, আর এরই মধ্যে উন্নত অর্থনীতিগুলো মন্দার দিকে যাচ্ছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক সংকটের কারণে একদিকে জ্বালানি তেল, খাদ্যের কাঁচামালসহ দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে।
অন্যদিকে ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির হার ৮.৮% ছুঁয়ে রেকর্ড করেছে, যা ২০২১ সালে ৪.৭% ছিলো। ফলস্বরূপ, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এসবই খুচরা বিক্রয় বাজারকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে ব্যাহত করছে।
যদিও শিল্পের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, পাশাপাশি সুযোগও রয়েছে সীমাহীন। লক্ষণীয় বিষয় যে- পোশাক রপ্তানি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আশা জাগানিয়া।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ছিলো ৪২.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পোশাক শিল্পের ৪০ বছরের যাত্রাপথে ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ছাড়িয়ে যাওয়া শিল্পের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক। আমাদের প্রধান দু’টি রপ্তানি বাজার- ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অপ্রচলিত বাজারগুলোতে রপ্তানি শেয়ার ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৬.৮৭% থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪.৯৬% পৌঁছে দ্বিগুণ হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধিসহ প্রধান অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া।
২০২১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘বিশ্ব বাণিজ্য পরিসংখ্যান পর্যালোচনা’ অনুসারে, বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে ৬.৩৭% শেয়ার নিয়ে বিশ্বের ২য় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য শীর্ষ ডেনিম-সোর্সিং দেশে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা চীনের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারকদের সাথে ঘনিষ্ঠ প্রতিযোগিতায় রয়েছি।
২০২২ সাল আমাদের জন্য একটি বিশেষ বছর হয়ে থাকবে। কারণ, এই বছরেই আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ছাড়িয়েছি, যখন কিনা আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছি। আবার একই সময়ে বছরটি বাংলাদেশের অবকাঠামোগত যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়নের জন্য একটি বিশেষ বছর হয়েই থাকবে। কারণ এ বছরে পদ্মা সেতু চালু হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে এবং আরও অনেক মেগা প্রকল্প সমাপ্তির পথে রয়েছে। এ বছরটি সত্যিই বহু অর্জনের বছর।
২০২২ সালে আমাদের পোশাক শিল্পের সাফল্যের তালিকায় অনেকগুলো অর্জন যুক্ত হয়েছে। এ বছরে আমরা যে বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দিয়েছি, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘অ্যাপারেল ডিপ্লোমেসি’।
২০২২ সালে আমরা ইএসজি অগ্রাধিকার এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে পোশাক শিল্পের রূপকল্প প্রণয়ন করেছি। আমাদের রয়েছে ইউএসজিবিসি কর্তৃক প্রত্যায়িত সর্বোচ্চ সংখ্যক লিড গ্রিন কারখানা। বর্তমানে লিড গ্রিন কারখানার সংখ্যা ১৮০টি, যার মধ্যে ৫৮টি প্লাটিনাম রেটেড।
আমরা শুধুমাত্র সাসটেইনেবিলিটির মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ থাকিনি। বরং, বিজিএমইএ তার নিজস্ব প্রাঙ্গনে ‘‘সেন্টার ফর ইনোভেশন, ইফিশিয়েন্সি এন্ড ওএসএইচ’’ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা দক্ষতা উন্নয়ন এবং ব্যয় অপ্টিমাইজেশনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির নতুন উপায়গুলোর উপর মনোনিবেশ করবো।
২০২২ সালের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো বিজিএমইএ'এর উদ্যোগে “মেইড ইন বাংলাদেশ উইক” উদযাপন।
শুধুমাত্র ২০২৩ সালই নয়, পরবর্তী দশকেও আমাদের এই সমস্ত রূপান্তর ধরে রাখতে হবে। আমাদের খাতটির মূল সুযোগ রয়েছে পণ্য, ফাইবার, বাজারের বহুমুখীকরণ এবং মূল্য সংযোজনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মধ্যে। আমাদেরকে ব্যাকওয়ার্ড এবং ফরওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একই সময়ে, উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত আপগ্রেডেশন, নকশা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং সামগ্রিক ব্যবসায়িক সক্ষমতার উপর জোরালোভাবে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
সবুজ রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমাদের উদ্যোগগুলোকে তরান্বিত করতে হবে এবং সকল কারখানা, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো যেন এই উদ্যোগগুলোতে সম্পৃক্ত হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্ব বাজারে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল মার্কেটপ্লেস গেটওয়ে হতে পারে।
লেখক: মোঃ মহিউদ্দিন রুবেল, পরিচালক, বিজিএমইএ