প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

আত্মহত্যা কেন তরুণ-তরুণীদের বেশি টানছে?

সোহেল রানা
১৭ জুলাই ২০২২ ১৬:২৪:২৫ | আপডেট: ১ year আগে
আত্মহত্যা কেন তরুণ-তরুণীদের বেশি টানছে?

২৫ জুন একটা সংবাদ শিরোনাম: ‘খুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের আত্মহনন…’, থেকে  আজকের লেখাটির সূত্রপাত। লিখতে লিখতে সালভাদোর দালির একটা কথা হঠাৎ মাথায় আসলো- ‘আমি জীবনটাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি(I absolutely love life)’। কেন? কারণ, ‘আমার জীবনে এমন সব কিছুই আছে, যা একদিন পাবার স্বপ্ন দেখেছিলাম’।

হ্যাঁ সত্যিই, মানুষের জীবনে যখন আর কিছুই পাবার থাকে না; কিংবা জীবন তাকে নিদারুণভাবে বঞ্চিত করে; কিংবা জীবনের প্রতি প্রচণ্ড অভিমান তৈরি হয়; তখন জীবন আর তার কাছে ফুলশয্যা থাকে না, হয়ে ওঠে কাঁটা। জীবন-কাঁটার উপর পড়ে পড়ে সে রক্তাক্ত হতে থাকে। আর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ‘এ জীবন চাই না’ বলার প্রবণতা।

হ্যাঁ, মানুষের হতাশা ঠুনকো কারণে কিংবা বড় কোন কারণেই হোক না কেন- সে অনেক সময় নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন সে ‘বিশ্ব ভরা প্রাণের মাঝে’ নিজেকে একা ভাবতে শুরু করে। আর তখনই আসে তার নিজের জীবন শেষ করে দেবার পরিকল্পনা, মানে আত্মহত্যা। আপাতদৃষ্টিতে, আমার আপনার কাছে মৃত্যুর কারণ ছোট মনে হলেও, সেই  ছোট কারণই ঐ মুহূর্তের জন্য ওই ব্যক্তির কাছে অনেক বড় কারণ হয়ে ওঠে।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক।   

সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘হেমলক সোসাইটি’ নামক সিনেমাটি অনেকেই দেখে থাকতে পারেন! এই ছবিটির নাম আমেরিকার সান্তা মনিকায় অবস্থিত হেমলক সোসাইটি থেকে নেওয়া হয়েছে। সংস্থাটির মূল উদ্দেশ্য হল আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক মানুষদের আইনি সহায়তা এবং মনোবিদের সাহায্যে আত্মহত্যা থেকে বিরত করা।

সিনেমাটির গল্প একটি আত্মঘাতী মেয়ে মেঘনা এবং আত্মহত্যায় সহায়তাকারী একটি সংস্থা হেমলক সোসাইটির পরিচালক আনন্দ করকে নিয়ে আবর্তিত।

গল্পের এক পর্যায়ে দেখা যায়, জীবনের নানা অপ্রাপ্তি আর হতাশা আর তা থেকে উদ্ভূত জীবনের প্রতি ঘৃণা মেঘনাকে আত্মহত্যা করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করে। কিন্তু ঘটনাক্রমে আনন্দের সাথে তার দেখা হবার পর জীবনের গতিপথ আর ফিলসফি পরিবর্তিত হতে থাকে।

নায়ক আনন্দ করের ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ বরণকারীদের সাহায্যের জন্য গড়ে তোলা সংস্থায় ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ গ্রহণের প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত একটি ক্র্যাশ কোর্সে ভর্তি হবার পরেই মেঘনার জীবনের নাটকীয় পরিবর্তন হতে থাকে।

তবে সিনেমাটির শেষে জীবনেরই জয় হয়। যে যে কারণে মেঘনা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল, বিভিন্ন কোর্স করার পর আর ক্লাসে বিভিন্ন মানুষের বিচিত্র জীবনের গল্প শুনে মেঘনার নিজের জীবনের প্রতি টান বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে বুঝতে শেখে যে, অন্যদের তুলনায় তার জীবনের অপ্রাপ্তি বা দুঃখবোধ খুবই সামান্য। যেসব কারণে সে সুইসাইড করতে চেয়েছে সেগুলো আসলে যাপিত জীবনের খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা। আত্মহত্যা আর স্বেচ্ছামৃত্যু সম্পর্কে এতো কিছু জানার পর, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার পর শেষ পর্যন্ত তাই মেঘনা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

গল্পটা জীবনের প্রতি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই শেষ হয়! কিন্তু জীবন আর গল্প তো এক না। সিনেমার গল্প পরিচালকের ইচ্ছার ওপরে নির্ভর করলেও, আত্মহত্যা সম্পূর্ণই ব্যক্তি মানুষের ওপর নির্ভর করে।

আত্মহত্যার প্রতি কেন মানুষের মন বেশি ঝুঁকছে, সেটাই দেখার চেষ্টা করা যাক।

আত্মহত্যা হলো নিজেকে নিজেই হত্যা করা। বলা হয়, অস্বাভাবিক চিন্তার জগতের থেকে সম্পাদিত যে কাজ সেটাই হলো আত্মহত্যা। এই আত্মহত্যা বা সুইসাইড সব ধরনের মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।

নায়িকা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, লেখক, গায়ক-গায়িকা অনেকেই ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। ইতিহাসের কিছু আলোচিত বা আলোড়িত আত্মহত্যার উদাহরণের মধ্যে-ক্লিওপেট্রা, নিরো, এডলফ হিটলার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ক্রিস বেনওয়েট, ভিনসেন্ট ভ্যন গগ, রবিন উইলিয়ামস, সুন্দরী অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো, বিশ্ববিখ্যাত মিউজিক ব্যান্ড লিংকিং এর গায়ক ও প্রধান গীতিকার চেস্টার বেনিংটন এবং সম্প্রতি ভারতীয় অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত!

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করেন। দৈনিক আত্মহত্যা করেন দুই হাজার ১৯১ জন। যা প্রতি লাখে ১৬ জন। অন্যদিকে, আমেরিকায় প্রতি বছর গড়ে ৪৫ হাজারের অধিক মানুষ আত্মহত্যা করে।

আত্মহত্যা কারা করে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি করে থাকে হতাশাগ্রস্থ তরুণ-তরুণীরা। বয়স্কদের মধ্যেও আত্মহত্যা দেখা যায়। যেমন, জাপানে প্রবীণদের মাঝে আত্মহত্যার মাত্রা বেশি। আবার দেখা গেছে, ধনী দেশগুলোর চেয়ে গরিব দেশের মানুষ বেশি আত্মহত্যা করে। তবে রাশিয়াতে প্রচুর ধনী মানুষও আত্মহত্যা করে থাকেন। আবার নারীরা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, যা পুরুষদের বেলায় খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না।

স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি (লাখে পঁচিশের ওপরে)। গত ৫০ বছরে সারা পৃথিবীতে, মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। ফ্রান্সে প্রতি বছর গড়ে ৯ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। ফ্রান্সের এই সংখ্যাটা ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বেশি  আত্মহত্যার সংখ্যা।

বাংলাদেশে আত্মহত্যার চিত্র কেমন?

সারা পৃথিবীর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, তার মধ্যে ২.০৬ শতাংশ বাংলাদেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ।

বিবিএস এর জরিপ আরও বলছে, বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ৩৫ জন। বিবিএস সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতি লাখে ৮ দশমিক ৫ জন আত্মহত্যা করেন (ডয়চে ভেলে বাংলা, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)।

আঁচল ফাউন্ডেশন নামক একটি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এর এক গবেষণায় উঠে আসে ভয়াবহ কিছু তথ্য। ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩টি জাতীয় পত্রিকা, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরিকৃত প্রতিবেদনে বলা হয়-

২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেন। এই আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ৮ হাজার ২২৮টি এবং পুরুষের আত্মহত্যার ঘটনা ৬ হাজার ২০৮টি। অথচ, এই সময় করোনায় প্রাণ হারান ৮ হাজার ৪৬২ জন। ২০২১ সালে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েরই কেবল ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। (প্রথম আলো, ১৩ মার্চ ২০২১)

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে দুই হাজার ১৬৬টি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর(বিবিএস) আরেকটি তথ্য বলছে, করোনার প্রথম বছর আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪ হাজার ৪৩৬টি। করোনার সময় নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল।

এদের মধ্যে, ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী রয়েছেন ৪৯ শতাংশ, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৫ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ১১ শতাংশ। সবচেয়ে কম আত্মহননকারী হচ্ছেন ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা- ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুইজন নারী, ‘অন্য কারণে’ আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন। আর ফেব্রুয়ারিতে আত্মহত্যা করেছেন মোট ১৫ জন নারী।

কেন আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে?

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ হতাশ হলে কোন কোন সময়ে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন তিনি নিজেকে একা মনে করে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আপাতদৃষ্টিতে, অন্যদের কাছে মৃত্যুর কারণ ছোট মনে হলেও ওই ক্ষুদ্র কারণই ওই মুহূর্তে ওই ব্যক্তির জন্য অনেক বড় কারণে পরিণত হয়।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আজহারুল ইসলামের মতে, ‘বিষণ্ণতা থেকেই মূলত মানুষ আত্মহত্যা করে। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ থেকে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না’।

আত্মহত্যার কারণগুলো যত তুচ্ছই হোক না কেন, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কাছে তা অনেক বড় একটি ঘটনা।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, জীবন নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট, দারিদ্র ইত্যাদি বেড়ে যাওয়া পাশাপাশি এসব দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নেয়নি বলেই মানুষের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। 

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, কোভিডকালীন সময়ে বাংলাদেশে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়, ৪৬ শতাংশ মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা, ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘এটা একাকীত্ব থেকে গভীর বিষন্নতার ফল’।

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য থেকে তৈরি হওয়া হতাশা থেকেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করেন, তখন সে আত্মঘাতী হন’।

আর আঁচল ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা বলছে, এইসব আত্মহননের পেছনে  রয়েছে পারিবারিক সমস্যা, হতাশা, সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা, নগর জীবনের নিঃসঙ্গতা ও আর্থিক সমস্যাসহ বেশ কয়েকটি কারণ। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান তানসেন এর মতে, ‘করোনার সময় তরুণদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। আর পরিবারগুলো যারা আর্থিক চাপে পড়েছে তাদের চাপ পড়েছে পরিবারের তরুণ সদস্যদের ওপর। একাকিত্বে প্রযুক্তির অপব্যবহার তাদের চরম হতাশার মধ্যে ফেলেছে। যার নির্মম পরিণতি আমরা দেখেছি’।

মুক্তির উপায় কি

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মোহিত কামাল মনে করেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী হতাশাগ্রস্ত থাকলে আত্মহত্যা করতে চাইবে, তাকে তখন সাপোর্ট দিতে হবে। কাউন্সিলিং করাতে হবে। এটা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। আর তা না করলে, আত্মহত্যা করলে এটা হত্যা বলে বিবেচিত হবে। বলা যায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাকে প্ররোচিত করা হয়’।

অন্যদিকে, ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতে, ‘যেহেতু করোনায় যারা বিষাদ বা হতাশার শিকার হয়েছেন তারা সবাই তো আত্মহত্যা করেননি। সুতরাং এখানেই জীবনের প্রতি ভালোবাসার গল্প আছে। আমাদের সেটাই বড় করে দেখানো উচিত। তারা তো হতাশাকে জয় করেছেন। যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে যথাসময়ে এই জীবনবোধ জাগাতে পারলে দুঃখজনক পরিণতি দেখতে হতো না’।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘আত্মহত্যাকে বাংলাদেশে মানসিক সমস্যা হিসেবে অ্যাড্রেস করতে অ্যাকশন প্ল্যান হাতে নেয়া হয়েছে। সেটি পাস হওয়ার প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্ল্যানটি পাস হলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হবে’।

কোনো মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হোক, তা আমরা কেউই চাই না। স্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের ইতি ঘটুক সেটাই সবার কাম্য। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু বা আত্মহত্যা কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এই লেখাটি শেষ হতে না হতেই সংবাদের শিরোনাম হয়েছে আরও একটি তরতাজা প্রাণ: সুইসাইড নোট লিখে ছাত্র ইউনিয়ন নেতার আত্মহত্যা (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, জুন ৩০, ২০২২)। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আত্মহত্যা বাংলাদেশে এখন মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। 

আত্মহত্যা প্রতিরোধে বেশি বেশি সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা ও মানসিক সহায়তা দানকারী  সংগঠন প্রয়োজন। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষদের হেল্পলাইনের মাধ্যমে সাহায্য দেয়া বেসরকারি একটা সংগঠন ‘কান পেতে রই’ এর নাম শোনা যায়। তাদের মূল উদ্দেশ্য, মানুষের হতাশা, একাকীত্ব, মানসিক চাপ এবং আত্মহত্যার প্রবণতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা, তাদের মানসিক সমর্থন যোগানো। বিশ্বের ৪০টি দেশে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা আত্মহত্যা রোধ করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় উন্নয়নের জন্যে অনেক অবদান রাখছে। সংগঠনটির দাবি, বাংলাদেশে ‘কান পেতে রই’ এ ধরনের প্রথম প্রতিষ্ঠান।

তাদের এই দাবি নিয়ে কোন আপত্তি নেই, তবে আমাদের দাবি, সরকারি ও বেসরকারিভাবে এই ধরনের হেল্পলাইনযুক্ত প্রতিষ্ঠান প্রতি জেলায় জেলায় গড়ে তোলা হোক।

মোটকথা, আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ বিশেষ করে তরুণদের পাশে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কউন্সেলিং ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। আর তাদের হতাশার জায়গাগুলো দূর করে তাদের সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী করতে হবে। তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না। অবহেলা করা করা যাবে না। সম্মান দিতে হবে। আত্মহত্যা বাংলাদেশে মানসিক রোগ হিসাবে দেখা হলেও, কেন এই রোগ বাড়ছে তা খুঁজে বের করে সমাধন করা উচিত।

সর্বশেষ যে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সাদাত মাহমুদ আত্মহত্যার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কারণ না জানা গেলেও, সাদাতের জীবনের পেছনের গল্প কিছুটা জানা সম্ভব হয়েছে:

“করোনা মহামারির সময় শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ঘটনায় ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করার অভিযোগ তুলে ২০২০ সালের নভেম্বরে সাদাতসহ দুই ছাত্রকে বহিষ্কার করে বেসরকারি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)। একই বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বেইলি রোডের দেয়ালে ধর্ষণবিরোধী গ্রাফিতি আঁকার সময় সাদাতসহ ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল রমনা থানা পুলিশ............ আন্দোলনের কারণে তাকে ইউল্যাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এটা একটা মানসিক চাপ তৈরি করেছিল। অনেক দিন ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেও তিনি ভর্তি হতে পারছিলেন না। তার পড়াশোনা লম্বা সময়ের জন্য আটকে যায়”(প্রথম আলো, ৩০ জুন ২০২২)।

এই লেখাটি চলাকালে রাজধানীতে একজন নারী সাংবাদিকের আত্মহত্যার খবরে আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরত্ব দেবার বিষয়টি: ‘হতাশা থেকে তুলি আত্মহত্যা করতে পারেন: পুলিশ’( ইত্তেফাক, ১৫ জুলাই ২০২২)।

সুতরাং ‘পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। কাউন্সেলিং-এর সুবিধা বাড়াতে হবে। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে’, এমনটাই মনে করেন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম।

তথ্যসূত্রঃ

বিবিসি বাংলা, ডয়েচ ওয়েলে বাংলা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস), মহিলা পরিষদ, আঁচল ফাউন্ডেশন, http://shuni.org/সোহেল রানা

লেখক পরিচিতি: সোহেল রানা, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী