প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধ রাখলে দুর্ঘটনা কী কমবে?

সাইফুল্ল্যা সাইফ
২৩ জুন ২০২২ ১৮:৩৩:২২ | আপডেট: ১ year আগে
ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধ রাখলে দুর্ঘটনা কী কমবে?

পত্রিকাগুলোতে দেখলাম আসন্ন ঈদুল আজহার সময় মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে মোটরসাইকেল রাইডারদের প্রতিক্রিয়াও দেখার মতো। এটা কোন দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হতে পারে না। তাই কিছু না লিখে পারলাম না বরং সংশ্লিষ্ট সকলের কাজে আসবে আমার লেখাটি এটাই প্রত্যাশা করি।

দীর্ঘদিন মোটরসাইকেল রাইডিং স্কীল ডেভেলপমেন্ট ও সেইফটি নিয়ে কাজ করে আসছি, বিষয়টি নজরে পড়ার পরে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হয়েছে, এ যেন সর্বরোগের ঔষধ প্যারাসিটামল প্রয়োগ করার মতো। মানে আমাদের সমস্যা ও দূর্বলতাগুলো পর্যালোচনা না করে এবং এর সমাধানের পথ না খুঁজে এটা কোন সুচিন্তিত মতামত হতে পারে না।

তীব্র ট্রাফিক জ্যাম, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা এবং করোনাভাইরাস সংক্রামণ রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দ্রুত শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলাচলে মোটরসাইকেলের বিকল্প কোন পরিবহন আপাতত নেই। তাই এর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো আসার পরে মোটরসাইকেল শিল্পের দ্রুত বিকাশ শুরু হয়।

বাংলাদেশে মোটরসাইকেল শিল্পটি খুবই সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিণত হচ্ছে। সরকার মোটরসাইকেল শিল্পকে এগিয়ে নিতে যখন নানা নীতি সহায়তা দিচ্ছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের সুপারিশ করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত বা পরামর্শ যাচাই-বাছাই ও পরামর্শ গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা হবে সকলের জন্য মঙ্গলকর ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান।

তাই আসুন দেখে নেই আমাদের প্রধান সমস্যাগুলো এবং কি কি সম্ভাব্য দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আমরা করতে পারি-

রুঢ় একটি বাস্তবতা হচ্ছে- সড়কে যত দ্রুত মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে দুর্ঘটনার শিকার অনেকের আজীবন পঙ্গুত্ব এমনকি মৃত্যু ঝুঁকিও বাড়ছে। এর প্রধান কারন অপরিপক্ক মোটরসাইকেল রাইডিং, সড়কে নিরাপদ থেকে সঠিক রাইডিং কৌশল ও জ্ঞানের অভাব।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সড়কগুলোতে প্রায় ১৭ ধরণের বাহন চলাচল করে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় শুধুমাত্র একজন মোটরসাইকেল রাইডারেরই দোষ বা ত্রুটি থাকে অন্যান্য সকল বাহনের চালকের কি কোন দোষ বা ত্রুটি নেই?

আমি এক্ষেত্রে একপক্ষকে সরাসরি দায়ী বা সমর্থন করছি না, শুধু বলবো অদক্ষতাই এর প্রধান কারণ। তাহলে আমরা কি করে বুঝবো- একজন দক্ষ রাইডার বা চালক কে? প্রশ্নটি খুবই সাধারণ কিন্তু গভীরতা অনেক বেশি।

সাধারণ চোখে দক্ষতা যাচাইয়ের সনদ হচ্ছে "ড্রাইভিং লাইসেন্স"। তবে বাস্তবতা হচ্ছে অনেকেই কিছুই চালাতে পারেন না কিন্তু লাইসেন্স ঠিকই আছে, অনেকটা অলৌকিকভাবে লাইসেন্স লাভ করেছেন।

এটা কি করে সম্ভব? এই বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। তাই গোড়ায় গলদ না করে সেই জায়গায়টাতে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত নয় কি?

এবার আসি নবীন মোটরসাইকেল রাইডারদের নিয়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র মোটরসাইকেল রাইডিং প্রশিক্ষণের জন্য কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যে কেউ ইচ্ছে করলে লাইসেন্স ও বাহনের বৈধ কাগজপত্র থাকলেই খুব সহজেই মোটরসাইকেল কিনে চালাতে পারেন।

ভুলে গেলে চলবে না আমরা খুব দ্রুত উঠে আসা উন্নয়নশীল দেশ তাই সকল ক্ষেত্রেই আমাদের উন্নয়ন প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোতে শুধুমাত্র মোটরসাইকেল লাইসেন্স পেতে হলে একটি রাইডিং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (ড্রাইভিং স্কুল নয়) থেকে একজন অভিজ্ঞ সার্টিফাইড মোটরসাইকেল রাইডার কোচ হতে প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্পূর্ন রাইডিং স্কীল ডেভেলপ করে লাইসেন্স অনুমোদন নিতে হয়।

কিন্তু আমাদের দেশে কি সেই ব্যবস্থা বা বাধ্যবাধকতা কি আছে? বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কি এ বিষয়ে কোন নীতিমালা বা নির্দেশনা আছে বা দিয়েছে?

অনেকেই বলবেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কতৃক অনুমোদিত প্রশিক্ষক আছে সেখানেও প্রশিক্ষণ নেয়া যায়। এবার আসি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অনুমোদিত প্রশিক্ষক হতে কি যোগ্যতা লাগে?

আমার জানামতে, প্রশিক্ষক হতে হলে কমপক্ষে দুই বছর বা তার বেশি সময় ভারী যানবাহনের পেশাদার লাইসেন্স থাকতে হবে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, চার চাকার ভারী বাহনের পেশাদার চালক ব্যাক্তিটি দুই চাকায় সমানভাবে কি করে পারদর্শী হয়? একজন ব্যাক্তি বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ শুধুমাত্র একটি বিষয়ের উপর হতে পারে, একইসাথে দুটি বাহনের উপর নয় সুতরাং সেখানে আমরা মোটরসাইকেল রাইডিং দক্ষতা উন্নয়নে কি প্রত্যাশা করতে পারি?

দীর্ঘ সময় মোটরসাইকেল রাইডিং করছেন এমন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজনকে রাইডারকোচ হিসেবে প্রয়োজন, ভারী যানবাহনের ড্রাইভার নয়।

মোটরসাইকেল রাইডিং এবং রাইডিংকালে সড়কে নিরাপদ থাকার কৌশল (Road Strategy) কিন্তু এক নয়, তাই দক্ষ ও নিরাপদ রাইডার গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিক্ষিত যুব শ্রেণী থেকে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাইডারকোচ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে। এবং নবীন রাইডারদের লাইসেন্সপ্রাপ্তিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণে বাধ্যবাধকতা থাকলে দুর্ঘটনার প্রবনতা ও আশংকা অনেকাংশে কমে আসবে আশা করি এবং ভবিষ্যতে এটিই হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান।

তাছাড়াও একজন চালককে মোটরসাইকেল রাইডিংকালে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। রাইডিং শিষ্টাচার ও কৌশল বিষয়ে একজন মোটরসাইকেল রাইডারকে পারদর্শী হওয়া খুবই জরুরি। বিশেষ করে অনেক মোটরসাইকেল রাইডারগণ লাখ টাকার মোটরসাইকেল কেনেন ঠিকই কিন্তু মোটরসাইকেল রাইডিং সেইফটি গিয়ার বা জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম নিয়ে উদাসীন থাকেন। সস্তার মধ্যে একটি হেলমেট পরিধান করে রাইডিং করেন। উদ্দেশ্য একটাই মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করা।

ভাল এবং মানসম্মত আন্তর্জাতিকভাবে ডট, ইসিই, স্নেল সার্টিফায়েড হেলমেট যেমন আছে, তেমনি পাশের দেশ ভারতে আইএসআই সার্টিফায়েড হেলমেট বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশে বিএসটিআই সনদপ্রাপ্ত হেলমেট বিক্রি বাধ্যতামূলক করা দরকার এবং তা মোটরসাইকেল রাইডারদের ব্যবহারে উৎসাহিত করা উচিত।

সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বয়সের হিসেব যদি আমরা করি- দেখা যাবে অধিকাংশেরই বয়স ২৪ এর নিচে। যে বয়সে মোটরসাইকেল রাইডিং-কে রোমাঞ্চকর মনে করা হয়। অপরিপক্ক ও সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে চলার প্রবণতা তাদের মধ্যেই বেশি লক্ষণীয় তাই এই বয়সের রাইডারদের বিষয়ে আরও যত্নশীল হওয়া জরুরি। তাদের রাইডিং শিষ্টাচার ও নিয়ন্ত্রিত গতিতে চালাতে উৎসাহিত করতে অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

সর্বোপরি সুদূরপ্রসারী সামান্য কিছু পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পরিমাণ বহুগুণ কমে যাবে, যা স্থায়ীভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে।

মোটরসাইকেল চালানো শেখাতে সারাদেশে মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে এবং বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নবীন মোটরসাইকেল রাইডারগণ রাইডিং শিষ্টাচার, দায়িত্বশীলতা ও নিরাপদ থাকার কৌশল শিখবেন। তাই মোটরসাইকেলের জন্য পেশাদার ভারী যানবাহনে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক নয়, শুধুমাত্র দীর্ঘদিন মোটরসাইকেল রাইডিং-এ অভিজ্ঞদের রাইডারকোচ লাইসেন্স দিন, লার্নিং ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে সাহায্য করুন।

অস্থায়ীভাবে নয়, ভবিষ্যতে সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমাদের স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে, জোড়াতালির সমাধান আমাদের আরো জটিল করে তুলবে। আর এই কাজগুলো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কতৃপক্ষের পক্ষে একা করা সম্ভব নয়, তাই প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক: সাইফুল্ল্যা সাইফ

ফাউন্ডার ও মোটরসাইকেল রাইডিং সেইফটি কনটেন্ট ক্রিয়েটর - "স্মার্ট রাইডার"