প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

উটের জকি হিসেবে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার শেষ হওয়ার গল্প

০৩ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৪৮:১১ | আপডেট: ৩ years আগে
উটের জকি হিসেবে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার শেষ হওয়ার গল্প

আরিফুজ্জামান মামুন

 

ড. এ কে আব্দুল মোমেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কাজ করেছেন আরব দেশে উটের জকি হিসেবে বাংলাদেশি শিশুদের ব্যবহার বন্ধে। দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে সফল হয়েছেন তিনি। খুব বেশি বছর আগের কথা নয় যখন নিজ চোখে বাংলাদেশি শিশুদের অনেক দূরের বিভিন্ন আরব দেশে উটের জকি হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে করুণ এই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হলেও বাংলাদেশের শিশুদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহার শেষ করার পেছনে রয়েছে তার সংগ্রামের গল্প।

বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন ১৯৯১ সালের শুরুর দিকে যে প্রচারণা চালিয়েছিলেন এবং এরপরই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ বাংলাদেশি শিশুদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া বন্ধ করতে সাহায্য করেছিল। ড. মোমেন তখন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের মেরিম্যাক কলেজের ব্যবসা পরিচালনা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সৌদি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশটির শিল্প উন্নয়ন তহবিলের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (পরামর্শক) হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন এবং প্রায়শই দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের সহায়তার জন্য সাহসী উদ্যোগ গ্রহণে তার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ড. মোমেন নারী ও শিশুপাচার এবং শিশুশ্রমের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরেছিলেন এবং তিনি পাচার বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোতে উটের জকি কমাতে সফল হন। সকল নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ বাসস্থান তৈরির স্বপ্ন দেখা ড. মোমেন বলেন, অনেক কর্মকর্তা আমার সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। তবে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বিষয়টি উত্থাপন না করলে এত দ্রুত সময়ে সাফল্য আসত না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, তিনি খুব খুশি ছিলেন কারণ উটের জকি হিসেবে শিশুদের ব্যবহার এবং বিদেশে নারীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার প্রচারণার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছিল। বিশ্ব মিডিয়া বিষয়টি দ্রুত তুলে নিয়েছিল, বলেন তিনি। বোস্টন থেকে দুবাই সফরকালে ড. মোমেন ৬০ থেকে ৭০ শিশুকে একটি জায়গায় উটের জকি হিসেবে কাজ করতে দেখেন, যাদের বেশির ভাগই ছিল বাংলাদেশি।

এই অমানবিক চর্চা বন্ধ করতে কীভাবে তারা প্রচারণা চালিয়েছেন তার বর্ণনা দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি তাদের দেখে চিন্তিত হয়েছিলাম। এই অনুশীলন (উট জকি) সম্পর্কে আমি শুনেছিলাম, তবে এটি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। ড. মোমেন, যিনি ম্যাসাচুসেটসের ফ্রেমিংহাম স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি ও ব্যবসায় বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি বাংলাদেশি শিশুদের দুর্বল স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে খুব ভারী হৃদয় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছিলেন এবং পরে তার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে গল্পটি শেয়ার করেছিলেন। তারা (শিক্ষার্থীরা) খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। আমরা শিশুদের উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি উটের জকি হিসেবে কাজ করা শিশুদের কিছু ছবিও তুলেছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে বিষয়টি গণমাধ্যমেও উঠে এসেছিল। বিভিন্ন জায়গায় শিশুদের আটকে রাখার বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছিল, জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

দুবাই যাওয়ার পথে তখন মুম্বাইয়ে ২৫ শিশুকে আটক করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতীয় রেডিওতে একটি বিজ্ঞাপন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম, তবে মুম্বাইতে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি আমাদের নয়াদিল্লি মিশনে যোগাযোগ করেছিলাম। ফারুক সোবহান তখন হাইকমিশনার ছিলেন। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ড. মোমেনকে ডেকেছিলেন এবং মুম্বাইয়ে যোগাযোগ স্থাপনে তাকে সহায়তা করেছিলেন। আমি জানতে পেরেছিলাম যে মুম্বাইয়ে আটক হওয়া সব শিশুই বাংলাদেশি। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং দিল্লির বাংলাদেশ মিশন তাদের বিষয়টি যাচাই করবে যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দেয়, বলেন ড. মোমেন। তিনি জানান, এই সময়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন সফরে এসেছিলেন। আমি তার সাথে সাক্ষাত করি। তিনি (শেখ হাসিনা) তাৎক্ষণিকভাবে বলেছিলেন যে, তিনি সংসদে এটি উত্থাপন করবেন। আমি তাকে বলেছিলাম বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করলে লাখ লাখ কণ্ঠ তার সাথে যোগ দেবে। তিনি আমাকে বললেন, শোনো- এটা আমার বিষয়, বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সে অনুযায়ী শেখ হাসিনা উটের জকি বিষয়টি বাংলাদেশ সংসদে উত্থাপন করেছিলেন।

ড. মোমেন বলেন, এক সকালে আমি সরকারের কাছ থেকে একটি চিঠি পাই যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল যে সরকার আমাকে মুম্বাইয়ে উদ্ধারকৃত ২৫ শিশুকে হেফাজতে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তিনি জানান, একটি শর্ত ছিল যে ওই শিশুদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং সরকার যখনই চাইবে ওই ২৫ শিশুকে হেফাজত নিতে পারবে। আমি রাজি হয়েছিলাম, বলেন ড. মোমেন। কিছু নিয়মের কারণে শিশুদের দুই ধাপে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। শিশুদের ২৫ জনের মধ্যে ১৭ জনকে বাংলাদেশে এতিমখানায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ৮ জনকে মুম্বাইয়ে রাখা হয় ভারতে বিচারের জন্য অভিযুক্ত পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে, বলেন ড. মোমেন। মানবিক কাজের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন ড. মোমেন। তিনি বোস্টনভিত্তিক অলাভজনক মানবিক সংস্থা ডব্লিউসিআই’র সভাপতিও ছিলেন। সংস্থাটি উপসাগরীয় দেশগুলোতে উটের জকি হিসেবে বিক্রি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে নাবালক কিছু ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনে সহায়তা করেছিল, যাদের সবাই পাঁচ বছরের কম বয়সী ছিল।

ড. মোমেন আরও জানান, দক্ষিণ এশীয় বা আরব দেশগুলোর পাচারকারীরা দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছ থেকে শিশুদের কিনে নিয়ে তাদের মুম্বাই বা করাচি বন্দর থেকে জাহাজে করে মধ্যপ্রাচ্যের ক্রেতাদের কাছে নিয়ে যায়। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শত শত শিশু সাপ্তাহিক রেসে অংশ নেয়, তবে করোনাভাইরাস মহামারিজনিত কারণে এবারের মৌসুম স্থগিত হয়েছে।

ধনী মালিক এবং ব্যবসায়ীরা সাধারণত তাদের গাড়ি থেকে এই রেস দেখেন। রেসের পরে ব্যাপক সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। মালিক এবং ব্যবসায়ীরা মজলিসগুলোতে সমাবেত হন। পরবর্তী মৌসুমে দুটি উৎসব নির্ধারিত রয়েছে। দুবাই ক্রাউন প্রিন্স ক্যামেল ফেস্টিভাল ২৩ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি এবং আল মারমুম হেরিটেজ ফেস্টিভাল চলবে ২৮ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত।

এক শীর্ষ সম্মেলনে নারী ও শিশু পাচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে সার্ক দেশগুলোর (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা) প্রধানদের প্রভাবিত করতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠনেও সফল হয়েছিল ডব্লিউসিআই। ড. মোমেন ‘এশিয়ান স্লেভ ট্রেড’ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে শুনানির ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি এবং মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘকাল ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দাসত্বের জন্য দক্ষিণ এশীয়দের পাচারের কাজ চলে আসছে। বাংলাদেশিদের পাশাপাশি যার ভুক্তভোগী ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং নেপালি নারী ও শিশুরা।