প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

গ্রামীণ মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করছে সরকারের দরিদ্র বান্ধব কর্মসূচী

মোঃ নূরুল আমিন
১৩ আগস্ট ২০২৩ ১৮:০১:৪৪ | আপডেট: ১ year আগে
গ্রামীণ মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করছে সরকারের দরিদ্র বান্ধব কর্মসূচী

গত ২৪ জুলাই, ২০২৩ তারিখ দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায় সরকারের নেয়া বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে শহরের চেয়ে গ্রামে দারিদ্র্য বেশি হারে কমছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে গ্রামে দারিদ্র্য কমেছে ৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং শহরে কমেছে ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। দারিদ্র্য হ্রাসে সরকারের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ভিজিডি কর্মসূচী, শিক্ষা উপবৃত্তি, টিসিবি’র মাধ্যমে ১ কোটি পরিবারকে চাল, তেল, চিনি, পেয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃদুগ্ধ ভাতা। মূল লক্ষ্য হলো পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়ন।

সরকারের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচীর একটি হলো আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ পর্যন্ত ৯টি জেলা ও ২১১ টি উপজেলা গৃহহীন বা ভূমিহীনমুক্ত হয়েছে। ৫,৫৪,৫৯৭ টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এদের জন্য সুপেয় পানি , বিদ্যুৎ, ভিজিএফ চাল এর ব্যবস্থা করা হয়েছে, এমনকি পুকুর খনন করে, সমবায় সমিতি করে, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বী করা হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মানুষ এখন খুশি।

তারপরেই হলো ভিজিডি কার্যক্রম। অস্বচ্ছল, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারী যারা ভূমিহীন, বয়স ২০ থেকে ৫০ বছর তাঁদের এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৬৪ জেলার ৪৯২ উপজেলায় ৪৫৮২ ইউনিয়নে ১০ লাখ ৪০ হাজার নারীকে প্রতিমাসে বিনামূল্যে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। পূর্বে এ চাল বিতরণে স্বচ্ছতা ছিল না কিন্তু বর্তমানে বস্তা প্রতি ৩০ কেজি চাল তালিকাভুক্ত উপকারভোগী নারীকে দেয়া হয়। স্বচ্ছতার সাথে উপকারভোগী নারীর একটি ব্যাংক একাউন্ট থাকে, সে হিসাবে প্রতি মাসে তিনি কিছু অর্থ জমা রাখেন, তাঁকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাঁর এ প্রশিক্ষণ ও সঞ্চয়কৃত টাকা দিয়ে তাঁকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা হয়েছে, এর মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্যের হার কমতে শুরু করেছে।

প্রতিবন্ধী ছাত্র/ছাত্রীদের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তির হার বাড়িয়ে প্রাথমিক স্তরে ৭৫০ টাকা হতে ৯০০ টাকায়, মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা হতে ৯৫০ টাকায় এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৯০০ টাকা হতে ৯৫০ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাষ্ট থেকে অস্বচ্ছল পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হয়। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্নাতক পর্যায়ে ১,৪৫,৯৮৯ জন শিক্ষার্থীর মাঝে প্রায় ৭৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫০,৫৩,৬৬১ জন শিক্ষার্থীর মাঝে প্রায় চৌদ্দশ পচাত্তর কোটি বায়ান্ন লাখ টাকা এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি বাবদ ৭,৬২,৫৯৩ জন শিক্ষার্থীকে প্রায় পাঁচশত তিন কোটি ষাট লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৫৯,৬২,২৪৩ জন শিক্ষার্থীকে প্রায় দুই হাজার আটান্ন কোটি ষাট লাখ টাকা উপবৃত্তি দিয়ে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১,১১,৮৪,৫০৪ জন শিক্ষার্থীকে প্রায় ষোলশত ছিয়ানব্বই কোটি ছাপান্ন লাখ টাকা উপবৃত্তি দিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার সুযোগ দেয়া হয়েছে যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার হার হ্রাস পেতে সাহায্য করেছে।

দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দিকে লক্ষ্য রেখে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫৭.০১ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৫৮.০১ লক্ষ জনে উন্নীত করা হয়েছে এবং মাসিক ভাতার হার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। এমনকি বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৪.৭৫ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ২৫.৭৫ লক্ষ জনে উন্নীত করা হয়েছে। তাঁদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৩.৫৫ লক্ষ থেকে ২৯ লক্ষ জনে বৃদ্ধি করা হয়েছে। অর্থাৎ এ বছরে এ সংখ্যা ৫.৩৫ লক্ষ জন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ভাতা প্রাপ্তিতে ঘটেছে একটি নীরব বিপ্লব। আগে অর্থ পেতে উপজেলায় যেতে হতো, মধ্যস্বত্বভোগীগণ অর্থে ভাগ বসাতো। এখন আর সে অবস্থা নেই। মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সহজভাবে তাঁরা অর্থ পেয়ে যাচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশের পরিক্রমায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কর্তৃক প্রতি মাসে নিম্ন আয়ের ১ (এক) কোটি পরিবারের মধ্যে সরকার নির্ধারিত ভর্তুকি মূল্যে চিনি, মসুর ডাল, সয়াবিন তৈল বিক্রি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে স্বল্প মূল্যে চাল বিক্রি শুরু হয়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে টিসিবি ১ কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারে মোট ৭২,৫৭৪ মে.টন চিনি, ১,৮৭,০২২ মে.টন মসুর ডাল, ১৮ কোটি ৬৫ লক্ষ লিটার ভোজ্যতেল, ৯,৪২৬ মে.টন পেয়াজ, ৯,২৩০ মে.টন ছোলা বিক্রি করেছে। আগে রাস্তা থেকে যে কেউ ক্রয় করতে পারতো, বর্তমানে নিম্ন আয়ের যারা প্রাপ্য তাদের নাম তালিকাভুক্ত করে কার্ডের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। এতে করে দরিদ্র পরিবারটি প্রতি মাসে স্বল্প মূল্যে খাদ্য পণ্য পেয়ে উপকৃত হচ্ছে, তাঁর পরিবারের সদস্য উপকৃত হচ্ছে। ভর্তুকি সুবিধা নিম্ন আয়ের জনগণ পাচ্ছে, তা দারিদ্র্যের হার কমাতে সহায়তা করছে।

মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে উপকারভোগীর সংখ্যা ১২ লাখ ৫৪ হাজার হতে ১৩ লাখ ৪ হাজার জনে উন্নীত করা হয়েছে। দরিদ্র গর্ভবতী মায়েদের কল্যাণে মাতৃত্বকালীন ভাতার মাধ্যমে দিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে শিশুর ৪ বছর বয়স পর্যন্ত পুষ্টি চাহিদা পূরণ, শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, প্রতিবছর বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইভাবে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লক্ষ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে বরাদ্দ ১২, ৬৯৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যার ফলে আরও বেশি সংখ্যক দরিদ্র মানুষ উপকৃত হবে এবং দারিদ্র্যের হার আরও হ্রাস পাবে।

লেখক: মোঃ নূরুল আমিন। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন ও সাবেক সিনিয়র সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার