প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

দিন শেষে বিসিএস একটি চাকরি

আফরিন আপ্পি
০১ আগস্ট ২০২১ ১৯:০৪:০১ | আপডেট: ২ years আগে
দিন শেষে বিসিএস একটি চাকরি

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে একটি ক্রেজ চলছে। আর সেটি হলো বিসিএস ক্রেজ। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বর্ষ থেকেই দেখা যায় শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরিমুখী হতে। এটা খুব ভালো কথা পড়ালেখায় আগ্রহী হচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা। তবে তাদের হাতে থাকে শুধু বিসিএসের বই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বিস্তৃত লেখাপড়ার সাথে পরিচিত হবার আগেই শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ-ই আটকে যায় বিসিএসের জালে। যে জাল থেকে বের হতে লেগে যায় দীর্ঘ ৮ থেকে ৯টি বছর।

আজ এমন একটি দিন যেদিন ৪ লাখ ৪ হাজার ৫১৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২১ হাজার ৫৬ জন তরুণ-তরুণী তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে একধাপ এগিয়ে গেছেন। ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই পিছিয়ে পড়াদের অধিকাংশই ডুবে গেছেন ভীষণ হতাশায়। আর যারা সফল হয়েছেন তারা রাত-দিন এক করে হয়ত শুরু করেছেন লেখাপড়া। তবে মাস খানেক পর এই দল থেকেও ছিটকে পড়বেন প্রায় ১৯ হাজার চাকরি প্রত্যাশীরা। এ যেনো একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চূড়ান্ত বিজয়ের মুকুট পরবেন মাত্র ২ হাজার জন।

এভাবে এক চক্রে আবর্তিত হতে থাকে জীবন। এরই মাঝে বয়স ৩০ শেষ। বিসিএস নামক সোনার হরিণের অন্ধ অনুসরণ করে আর কোথাও চাকরির জন্য চেষ্টাও করেন না তারা। ফলশ্রুতিতে হতাশা গ্রাস করে ওই শিক্ষার্থীদের। পারিবারিক চাপ, আত্মীয়স্বজনের চাপ, বন্ধুদের অন্য চাকরিতে সফলতা। সবকিছু মিলিয়ে এক ভয়াবহ অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় এক একজন তরুণ-তরুণীকে। অনেকের কাছে জীবনটাই মনে হতে থাকে বোঝা। 

বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে। না হলে জীবন চলবে না। এ কথাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে শুনে আসছি। শুনছি এখনও। বন্ধু-আড্ডা, গান, নাটক, আবৃত্তিচর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সংগঠনের সাথে নিজেকে না জড়িয়ে বিসিএস-এর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকছে বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীরা। যে বিষয়ে তারা স্নাতক-স্নাতকোত্তর করছেন সে বিষয়েও জ্ঞানার্জনের সময় নেই তাদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখেছি বিসিএস পরীক্ষার কারণে সিনিয়রদের অনেককে বাড়ি না যেতে। বিসিএস-এর আশায় দিনের পর দিন স্বজনবিহীন থেকে একাগ্রচিত্তে করেছেন লেখাপড়া। এমনকি বাড়ি থেকে ফোন দিলেও কথা বলতে বিব্রতবোধ করতেন অনেকে। প্রশ্ন করেছি এর কারণ কী? উত্তর পেয়েছি: বাড়ি গেলেই সবার প্রশ্ন- কী করছো? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তাদের জানা নেই। সেজন্য লজ্জায় বাড়ির পথে পা বাড়ান না তারা।

কেউ যদি কেবল বিসিএসকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ধরে বসে থাকে তাহলে সেটি তার জীবনের জন্য যে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত হবে তাতে কোনো ভুল নেই। বিভিন্ন বিসিএস-এ যারা সফল হয়েছেন, যারা প্রথম হয়েছেন, তাদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে দেখেছি বিসিএস কখনোই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। তাদের সিংহভাগ অন্তত ৩ থেকে ৪টি চাকরি করে তারপর বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন।

সবাই যদি বিসিএস ক্যাডার হতে চায় তাহলে দেশে বড় বড় উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, গবেষক, বিজ্ঞানী, লেখক-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তৈরী হবে কীভাবে?

যেকোনো মূল্যে আমাকে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে এ ভাবনাটা তরুণ প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষার হার ও কর্মসংস্থানের প্রেক্ষাপটে এটা খুব ভয়াবহ। বিসিএস-এর বিকল্প ভাবনাটাও ভেবে রাখতে হবে। সে লক্ষ্যে পরিশ্রম করে নিজের মেধার সঙ্গে কাজের সমন্বয় করতে হবে। 

যে যেদিকে ভালো করতে পারবেন সেদিকেই মেধাকে কাজে লাগান। নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা আপনার ভেতরে এমন কিছু দিয়েছেন যা অন্যকে দেন নাই। সেই গুনটিকে খুঁজে বের করুন। নিজেকে জানুন। নিজের সঙ্গে কথা বলুন।

উঠুন, জাগুন, ঘুরে দাঁড়ান। দেখিয়ে দিন বিশ্বকে। লোকে কী বলে সেই ভাবনা না ভেবে নিজের মনের কথা শুনুন। আপনি কী চান। আর সেই চাওয়ার পেছনে আপনার পরিশ্রম কতটুকু। 

জীবন আপনার। জীবনের ভালো-মন্দের দায়িত্বও আপনার। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট পেশার গণ্ডিতে নিজেকে বেঁধে না ফেলে চিন্তা করুন বড় পরিসরে। সে লক্ষ্যে এগিয়ে যান সামনে। লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে পরিশ্রম করুন রাত-দিন। বিশ্বাস করুন সফলতা আসবেই।

আফরিন আপ্পি