"বড় বড় নামকরা স্কুলে বাচ্চারা বিদ্যার চাইতে অহংকারটা বেশি শিক্ষা করে।" কথাটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের দেয়ালেও কথাটি লেখা ছিল একসময়। এখনও আছে কি না, আমি ঠিক জানি না। তবে সেখানে কথাটির পাশে যার নাম ছিল, এবং অনেকেরই ধারণা কথাটি যার, তিনি আহমদ ছফা। মজার ব্যাপার হলো, এই কথাটির উল্লেখ আহমদ ছফার 'পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ' বইয়ে থাকলেও, কথাটি তার নিজের নয়। কথাটি তার বন্ধু মোস্তানের। মোস্তান মানে নাজিম উদ্দীন মোস্তান, ইত্তেফাকের এক সময়কার সিনিয়র রিপোর্টার। তো, এই কথাটির প্রেক্ষাপট বেশ আগ্রহোদ্দীপক।
মোস্তানের সঙ্গে যখন আহমদ ছফার প্রথম আলাপ, তখন তিনি মেতে আছেন চাষবাস নিয়ে। এরই মধ্যে তিনি পড়েন আন্তন ম্যাকারেঙ্কোর লেখা 'রোড টু লাইফ' নামের একটি বই। ম্যাকারেঙ্কো ছিলেন রুশ শিক্ষাবিদ। তিনি বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার টোকাই ভবঘুরে এবং অনাথ এতিমদের শিক্ষা দেয়ার একটি সুন্দর পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। বইটি পড়ার পর সেই পদ্ধতি আহমদ ছফাকেও প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তখন মোস্তানের সঙ্গে তার বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকায়, মোস্তানকে তিনি বইটি পড়তে দেন। বইটি পড়ে একই রকমের প্রভাবিত হন মোস্তানও। আহমদ ছফা ও মোস্তান নাশতার টেবিলে বসেই আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করে ফেলেন, কাঁটাবন বস্তির শিশুদের জন্য একটি স্কুল করে আন্তন ম্যাকারেঙ্কোর আইডিয়াগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন।
যেই ভাবা সেই কাজ। অনেক ঝড়ঝাপটা সামলে, প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে, তারা সেই স্কুলের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন। তবে এক্ষেত্রে আহমদ ছফার চেয়েও বেশি শ্রম ও অধ্যবসায় ছিল মোস্তানেরই। কিংবা কে জানে, স্মৃতিচারণাটি আহমদ ছফার বলেই হয়তো তিনি নিজেকে কম কৃতিত্ব দিয়ে, বেশি প্রশস্তি গেয়েছেন তার বন্ধুর। তবে যা হোক, আহমদ ছফার নিজের ভাষ্যমতে, তিনি স্কুলের সঙ্গে ছিলেন নামকাওয়াস্তে। সিলেবাস ঠিক করা, পড়াশোনা করানো সব কাজ করতেন মোস্তানই। অফিসের সময়টুকু বাদে সমস্ত অবসর তিনি বাচ্চাদের পেছনে দিতেন।
তবে এখানেই শেষ নয়। মোস্তান ছিলেন দুই কন্যার পিতা। নিজের মেয়ে দুটোকেও তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে বসিয়ে দিতেন। আহমদ ছফা বলতেন, "একটু কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, মোস্তান?" জবাবে মোস্তান বলতেন, "বস্তির ছেলেদের সঙ্গে বসতে না শিখলে কোনো বাচ্চা সঠিক মানুষ হতে পারবে না। বড় বড় নামকরা স্কুলে বাচ্চারা বিদ্যার চাইতে অহংকারটা বেশি শিক্ষা করে।"
মোস্তানের থেকে ধার করেই আমিও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত আমার সমবয়সী বন্ধু কিংবা ছোট ভাইবোনদের এটুকুই বলব, "বস্তির ছেলে" কিংবা সমাজের দৃষ্টিতে পশ্চাৎপদ যেকোনো পেশাজীবী মানুষের সন্তানের সঙ্গে বসতে না শিখলে আসলেই সঠিক মানুষ হওয়া যাবে না। আজ কেউ যদি বলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের শিক্ষার্থীরা রিকশাওয়ালার সন্তান, এতে ট্রিগার্ড হওয়ার কোনো মানেই হয় না। যে বা যারা এ ধরনের কথা বলে, তারা রিকশাচালক বা এ ধরনের পেশাজীবী মানুষকে খাটো করে দেখে বলেই এ জাতীয় কথাবার্তা বলতে পারে। তাদের কথায় ট্রিগার্ড হওয়া মানে একটা আশঙ্কা থেকে যাওয়া যে নিজেদের অবচেতন মনেও আমরা একই ধরনের চিন্তাচেতনাকে ঠাঁই দিচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট কিংবা অন্য যেকোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সঙ্গে গরিব-বড়লোক জাতীয় স্থূল বিষয়কে না টানাই ভালো। এমনকি স্রেফ মজা করেও "আমরা তো গরিব" জাতীয় কথাবার্তা বলাটা উচিত নয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি কম বলে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা অনেক বাবা-মায়ের সন্তানই এখানে পড়তে পারে এবং এটিই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিকগুলোর একটি। কেউ উপহাস করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের রিকশাওয়ালার সন্তান বললেই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী রিকশাওয়ালার সন্তান হয়ে যায় না।
তবে যারা আসলেই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, তারা কিন্তু আমাদের সকলের গর্ব ও আদর্শ। আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক কম প্রিভিলেজড বা সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েও তারা নিজেদের যোগ্যতায় জীবনে এতদূর আসতে পেরেছে। তাদের পাশাপাশি এক শ্রেণিকক্ষে বসে পড়াশোনা করে আমরা যেন সঠিক মানুষ হতে পারি, সৃষ্টিকর্তার কাছে সেই প্রার্থনা করি। পাশাপাশি আরও প্রার্থনা করি, বড় বড় স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে আমরা কেউ যেন অহংকার করতে না শিখি, প্রকৃত বিদ্যাটাই অর্জন করতে পারি।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাবি।