বাড়িতে আব্বু খুবই অসুস্থ। সবাই ডাক্তার-কবিরাজ নিয়ে ব্যস্ত। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে বাবার হাতে কোন সমস্যা ছিলো না। কিন্তু পা নড়াচড়া করতে পারতো না। শুধু চেয়ে থাকতো প্রিয় মানুষগুলোর দিকে। কক্সবাজারের অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাবার অবস্থা অবনতির দিকে গেলে চিকিৎসক চট্টগ্রাম মেডিকেল নিয়ে যেতে বলেন।
বাড়িতে সবাই যার যার মতো টেনশনে, ছোটরা কান্নাকাটি, মা তো শুধু আমার দিকে চেয়ে থাকত আর আমাকে সাহস যোগাত। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে বাবা আমাকে চোখের ইশারায় তার খুব কাছে ডাকেন। আমিও বুঝতে পেরে আমার কানটা আব্বুর ঠোঁটের কাছে দিই। তখন বাবা আমাকে বলতে লাগলেন আমাকে মেডিকেলে নিয়ে চল, আমার শরীরে খুবই অশান্তি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চল।
সাথে পাশের মুরুব্বিরা ছিল। তারা বলতে লাগল আজকে তো নেওয়া যাবে না, আগামীকাল শুক্র-শনিবার নিয়ে যাও। আমি কারও কথা না শুনে মাকে সাথে নিয়ে সিএনজি নিয়ে সোজা কক্সবাজার টার্মিনাল, সেখান থেকে বাসে করে চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে বাবাকে নিয়ে গেলে ডাক্তার বাবাকে দেখা মাত্র ভর্তি করেন। কয়েকদিন পর বাবা মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠেন। আমি আব্বুর পাশে শুয়ে ছিলাম, বেশ কয়েকদিন ঘুমাতে পারিনি তাই শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাবা মাকে চায়ের কথা বলেছিলেন। মা আমাকে ঘুম থেকে ডাকেন কিন্তু বাবা বারণ করেন এবং বাবা-ই চায়ের জন্য যায়। ১০ মিনিট, ২০ মিনিট, আধা ঘন্টা হয়ে যায় বাবা যখন আসছে না, মা আমাকে ডাকতে শুরু করে আমি উঠে এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে থাকি বাবাকে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। আনুমানিক ২ ঘণ্টা পুরো চট্টগ্রাম মেডিকেল তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাইনি। আমি তো তখন প্রায় পাগল।
এরপর হঠাৎ গেটের সামনে একজন অপরিচিত লোক বলতে লাগল আমাকে একটু আমার ছেলেটার কাছে পৌঁছে দিবেন আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। তখন আমি বাবাকে খেয়াল না করলেও বাবা আমাকে খেয়াল করেন। ডাক দেয় ওই তো আমার ছেলে বলে দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। কাউকে তো কিছু বলতে পারছি না শুধু আকাশের দিকে চেয়ে থাকছি আর চোখের পানি পড়ছিল।
মেডিকেলে আব্বু প্রথমে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শাহাব উদ্দীনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। একদিন ডাক্তার শাহাব উদ্দীন আমাকে তার রুমে ডেকে আব্বুর ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে বললেন। শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে। ডাক্তার আমাকে শান্তনা দেয়, বলে আপনার বাবা ভাল হয়ে যাবে। আমি আব্বুর পাশে এসে যখন আমার কপালটা বাবার কপালে রাখি, আমার চোখের পানি যখন বাবার কপালে পড়ে আমাকে বলে কাঁদিস না। আমার কিছু হয়নি আমি শীঘ্রই ভাল হয়ে যাব। পরে আমি আম্মুকে বাবার ক্যান্সার হয়েছে কথাটা বলি।
পরদিন ডাক্তার বাবাকে ক্যান্সার বিভাগে রেফার করে। একইদিন ক্যান্সার বিভাগ রেডিও থ্যারাপির জন্য ঢাকা ক্যান্সার হাসপাতালে রেফার করে। আমি আর আম্মু কয়েকদিন পর আব্বুকে নিয়ে ঢাকা যাই এবং ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি করে নয়টি রেডিও থ্যারাপি দিই। পরে ডাঃ আব্বুকে আবার চট্টগ্রাম মেডিকেলে রেফার করে। দু'দিন পর চট্টগ্রাম মেডিকেলে আব্বুকে আবার ক্যান্সার বিভাগে ভর্তি করাই।
সাতদিন চিকিৎসা দেয়, পরে ডাক্তার বাবাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে আসার ঠিক পনের দিন পর। দিনটি ছিল শনিবার। সকাল বেলা বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়। বলে পুতু হয়ত আমি আর বাঁচব না, আমার হায়াত হয়তো শেষ। তখন আমি কান্নাকাটি করলে বাবা আমাকে চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে দিয়ে মহান আল্লাহকে স্মরণ করতে বলে। ২৩ এপ্রিল ২০১৬ দুপুর ২টা তিন মিনিটের সময় আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান আমার বাবা আলহাজ্ব ফজলুল করিম।
বাবা অনেক না বলা কথা রয়ে গেছে। একদিন দু'দিন, সপ্তাহ, বছর পেরিয়ে সাত বছর চলে গেলো চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল। হয়তো এভাবে চলে যাবে যুগের পর যুগ। কিন্তু শেষ না হওয়া কথা রয়ে যাবে মনের অগোচরে।
লেখক পরিচিতি: জাফর আলম, গণমাধ্যমকর্মী