সম্প্রতি দু’একটি পত্রিকা নিউজ করেছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে’, ‘সরকারকে ধার দিতে টাকা প্রিন্ট করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক’। যদিও দেশের সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাপানো বা প্রিন্ট করা। এটাই তাদের কাজ। তবে সরকারকে ঋণ দিতে টাকা ছাপাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিষয়টি ঠিক নয়, এর কয়েকটি কারণ নিচে তুলে ধরছি।
বাংলাদেশ ব্যাংক কি ইচ্ছে করলেই টাকা ছাপাতে পারে বা ইচ্ছেমতো টাকা ছাপানো ঠিক কী না? সরকার এবার কেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে? কেনই বা সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিচ্ছে না? এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকেই জানেন আবার অনেকেই জানেন না।
প্রথমত, বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সরকার, যার বড় একটি উৎস ব্যাংক ব্যবস্থা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ঋণ নেওয়ার টার্গেট আছে সরকারের, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় বেশি।
সাধারণত অন্যান্য উৎস থেকে যখন সরকারের আয় কমে যায় অথবা ব্যয় বেড়ে যায় তখন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া বাড়ে। তবে সুদ পরিশোধ ব্যয় কমাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া একেবারেই কমিয়েছে সরকার। এছাড়া রাজস্ব আয় কম হওয়া বা অন্যান্য ব্যয় বাড়ার কারণে এ বছর সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ছে।
এবার আসি, সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশি নিচ্ছে কেন?
বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে রয়েছে। আর এই তারল্য বা লিকুইডিটি সংকটের পেছনে ডলার সংকটের বড় ভূমিকা রয়েছে। আমদানি বিল পরিশোধে ব্যাংকগুলোর যখন ডলার দরকার হয়েছে তখন তারা টাকা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার কিনেছে। এভাবে গত বছর ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে ১২ বিলিয়ন ইউএস ডলার সরবরাহ করেছে, এর পরিবর্তে সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা চলে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে অনেকটা, তাই সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার বা ঋণ নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে।
এবার বলছি, বাংলাদেশ ব্যাংক কি টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে কী না?
টাকা ছাপানোর ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি ইচ্ছেমতো যখন তখন টাকা ছাপাতে পারে? উত্তর হলো, না।
সরকার প্রতি বছর জিডিপি (গ্রোস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট) অথবা মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করে, এ অর্থবছরের জন্য যা ৬.৫ শতাংশ। এছাড়া ইনফ্লেশন বা মূল্যস্ফীতি একটা নির্দিষ্ঠ জায়গায় ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। এ অর্থবছরে যার টার্গেট ৭.৫ শতাংশ। এই টার্গেটগুলো মাথায় রেখেই মুদ্রানীতি ঠিক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ইচ্ছেমতো টাকা ছাপায়, তাহলে বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যেতে হবে, কারণ তখন মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। দেশের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেনই এই ভুল করবে? এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে এখন অনেক টাকা রয়েছে।
যেভাবে মুদ্রাবাজারের ব্যালেন্স ঠিক রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বর্তমান বাজারে যে পরিমাণ মুদ্রা সার্কুলেশনে রয়েছে তার সমপরিমাণ অ্যাসেট বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে রয়েছে। যা নেট ফরেন এ্যাসেট ও নেট ডমেস্টিক এ্যাসেট হিসেবে পরিচিত। তবে সার্কুলেশনে যে মুদ্রা রয়েছে তার একটা অংশ ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে আছে।
বর্তমানে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে নেট ফরেন অ্যাসেট কমছে আর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দেশি মুদ্রা বাড়ছে। এর ফলে বাজারে বা ব্যাংকগুলোর হাতে তারল্য বা টাকা কমে গেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে বাড়ছে।
এদিকে হিসাব সমান রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক এই বাড়তি টাকা আবার মার্কেটে ছাড়তে চায়। অন্যদিকে সরকারেরও টাকা প্রয়োজন, তাই এই বাড়তি টাকাই সরকারকে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে নতুন টাকা ছাপানোর প্রয়োজন নেই।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য বেশ কয়েকটি রি-ফাইন্যান্স স্কিম গঠন করেও মার্কেটের টাকা আবার মার্কেটে ফিরিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবেই মুদ্রাবাজারের ব্যালেন্স ঠিক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক কখন নতুন টাকা ছাপায়?
মার্কেট টুলস ব্যবহার করে নানা পর্যালোচনার পরে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রেখে চাহিদা মোতাবেক নতুন টাকা ছাপায় বাংলাদেশ ব্যাংক। যেমন- করোনাকালে বেশকিছু প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন টাকার প্রয়োজন ছিল। তবে সেক্ষেত্রে নানা বিচার বিশ্লেষণ করা হয়।
লেখক: মেহেদী হাসান
সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য বিজনেস পোস্ট