বাংলা একাডেমি কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ রচনার জন্য ফেলোশিপপ্রাপ্ত, বরেণ্য একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক ও বিজ্ঞানী ড. নূরুন নবীর অনবদ্য এক সরস রচনা ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধ ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন -ড. কিসিঞ্জারের দায়।’ গ্রন্থটির ছত্রে ছত্রে লেখক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীতে নিজের সম্পৃক্ততা, স্মৃতিচারণ ও অন্যান্য দালিলিক তথ্য সন্নিবেশ করেছেন।
একজন দর্শক হিসেবে নয়, নিজে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে ও আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে লেখক দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে ৭১-এ যুদ্ধকালীন পাকহানাদার বাহিনীর জঘন্য যুদ্ধাপরাধের প্রকৃত রূপ ও তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও সেদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. হেনরী কিসিঞ্জারের ঘৃণিত দায়ভার।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘটনা পরম্পরায় ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালরাত্রিতে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানির হানাদার বাহিনী শুরু করেছিল তৎকালীন ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল আর্চারকে ব্লাডের ভাষায় ‘বেছে বেছে গণহত্যা’ (The Cruel Birth of Bangladesh, Memoirs of an American Diplomat Archer K Blood), সে কালো রাত্রিতে লেখক নূরুন নবীর প্রতিরোধের চেষ্টা থেকে পরবর্তী নয় মাস সম্মুখ সমরে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে সম্পৃক্ততা ডায়েরির ন্যায় লিখিত গা শিউরে উঠা বাস্তব বর্ণনায় ঠাসা উক্ত গ্রন্থটি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব বিস্তারের হোলিখেলায় আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও আঞ্চলিক শক্তি ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। ভারত ও চীনের মধ্যে বিভিন্ন মতদ্বৈধতাহেতু চীন পাকিস্তানকে ও ভারত বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়। অপরদিকে এই উপমহাদেশে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের হীন প্রচেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সরাসরি অস্ত্র ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। আর মানবিক সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে দাঁড়ায়।
লেখক ড. নূরুন নবী গ্রন্থটিতে যেসব ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করে যে ভাষায় বর্ণনা করেছেন, সাধারণ ও বোদ্ধা পাঠক উভয়ের নিকটই ডায়েরি লিখার মতো মনে হবে। ফলে পড়বার সময় পঠক এক দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করে- পৃষ্ঠা উল্টে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন সরকারের প্রেসিডেন্ট ও উপদেষ্টার ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাস পূরণ অপরদিকে মার্কিন সাংবাদিক, মিডিয়া, সুশীলসমাজ ও অনেকে সিনেটরবর্গের মার্কিন নীতিকে লজ্জাকর ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবাদ ও রূখে দাঁড়ানো একই সময়ে ঘটে। ব্রিটশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও মার্কিন সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিনের বদৌলতে আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে ভয়াবহ অমানবিক গণহত্যার চিত্র ফুটে উঠে।
রবার্ট পেইন তার ‘ম্যাসাকার’ বইয়ে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের গণহত্যার বর্ণনায় যান্ত্রিক প্রকৃতি তুলে ধরেছেন। ‘হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের পর এরকম গণহত্যা আর হয়নি।’
লেখক আলাদা আলাদাভাবে ৭১-এ সংঘটিত গণহত্যা ও ধর্ষণ নিয়ে নানা প্রামাণ্য তথ্য হাজির করেছেন। এসব যুদ্ধাপরাধ পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের প্রতি চরম ঘৃণা লেখক কর্তৃক উদ্বৃত মি. রুমেলের প্রকাশিত বই ‘Death by Government’-এ বিধৃত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে ‘নাৎসিদের কাছে যেমন: ইহুদি, বাঙালি-হিন্দু সম্প্রদায় তেমনি ময়লা এবং কীট মূষিকা এবং তাদেরকে নির্মূল করতে হবে।’
লেখক তার স্ত্রী বকুলের বান্ধবী জয়ন্তী সরকারের বাবা জনপ্রিয় সংগীত শিক্ষককে পাক হানাদার বাহিনীর এদেশীয় সহযোগী রাজাকাররা কিভাবে মাথায় হাতুড়ি পিটিয়ে হত্যা করে এবং পরবর্তীতে মৃত দেহকে সাতখণ্ডে খণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে যে ইথনিক ক্লিনসিং-এর আতঙ্ক ছড়ানোর অতি ঘৃণ্য-বর্বর পদক্ষেপ নেয় তা সার্থকভাবে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও একদিনে দশ হাজার পলায়নপর শরনার্থীদের খুলনা জেলায় ডুমুরিয়া উপজেলায় চুকনগর গণহত্যার পাকহানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যার মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেছেন।
লেখক জনাব নবী মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিসেনাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে ভারত থেকে অস্ত্র ও ওষুধ নিয়ে আসতেন। তার নিজ গ্রাম মির্জাপুরে একদিনে পাঁচশত গ্রামবাসীকে নিষ্ঠুর ও নৃসংশভাবে হত্যার ঘটনা জলজ্যান্ত বর্ণনা করেছেন। এরকম সরস নিখুঁত বর্ণনা মনে হয় তার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা দ্বারাই শুধু সম্ভব।
ধর্ষণ অধ্যায়ে সেনাদের সভায় ভিন্নমত পোষণকারী এক বাঙালি সেনার মাধ্যমে জানিয়েছেন পাক হানাদার বাহিনীকে কীভাবে শীর্ষ স্থানীয় মহল থেকে বাঙালি নারীদের ধর্ষণের উৎসাহ দেয়া হলো।
নারীদের ওপর নারকীয় নির্যাতনের এক চাক্ষুস বিবরণ দিয়েছেন লেখকের নিজ জেলা টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের নিকটে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের পাশে ছাব্বিশা নামক গ্রামে। ১৯৭১-এর পরবর্তী ৩১ বছর পর একটি বেসরকারি গবেষণা কেন্দ্রের (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট : ওয়ার অ্যান্ড ওমেন, ড. এম এ হাসান, পৃ: ১৪৯-১৫০) নিকট সাক্ষ্য দেন নির্যাতিতা কিছু মহিলা। গা শিউরে উঠা রাজাকার-পাক বাহিনীর নির্যাতনকে সুজান ব্রাউনমিলার তাঁর বিখ্যাত বইয়ে (আওয়ার উইল : মেন অ্যান্ড ওমেন রেপ) লিখেছেন ‘বাংলাদেশে ধর্ষণ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানিদের নাৎসি এবং রাশিয়াতে জার্মানিদের ধষর্ণের সঙ্গে তুলনা করা যায়’। তিনি আরো লিখেছেন ‘বাংলাদেশে ধর্ষণ যুবতী ও সুন্দরীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আট বছরের বালিকা এবং পঁচাত্তর বয়সের দাদীমাদেরকে বাংলাদেশে নির্যাতন করা হয়েছিল।’
পাক হানাদার বাহিনীর এই অত্যাচারে সাধারণ সৈনিক থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের জেনারেল পর্যন্ত জড়িত ছিল।
১৯৭১-এর উদ্বাস্তুদের করুণ গাঁথা
লেখকের স্ত্রী জিনাত ফেরদৌস (বকুল) এর পিতা ফাহিমউদ্দিন আহমেদ জীবন ও পরিবারের সদস্যদের মান সম্মান রক্ষার্থে উদ্বাস্তু হয়ে কী করুণ ভাবে দিনানিপাত করেছেন কোটি উদ্বাস্তুদের একটি যেন প্রতিকৃতি হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি তার তিন মেয়ে ও নাতি ও নাতিনকে নিয়ে অন্য অনেকের মতো জীবনহানি ও সম্মান বাঁচাতে ভারতে শরণার্থী জীবন শুরু করতে বাধ্য হন। কোনো রকমে মাথা গোজার একটি কৃষকের ভাঙা গৃহ ব্যবস্থা করে কীভাবে অতি কষ্টে প্রতিটি দিন কাটিয়েছেন, তার মর্মন্তুদ বর্ণনা দিয়েছেন। ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ কোটি শরণার্থীর মানবেতর জীবনযাপন আহমেদ সাহেবের পরিবারের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধ ও নিক্সন- কিসিঞ্জারের দায়
পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও উদ্ভুত উদ্বাস্তু সমস্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব নতুন করে দেখে ১৯৭১ সালে। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড- এ বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করে প্রেরিত তার বার্তায় তিনি বলেছেন ‘আমরা ঢাকাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসের রাজত্ব দেখে বাগশক্তিহীন এবং ভয়ার্ত।’
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এই সব ভয়াবহ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ উপেক্ষা করে এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকে। ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ও মার্কিন সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন-এর বস্তুনিষ্ঠ গণহত্যার সংবাদ সারা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করে। সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডি তখনকার পরিস্থিতির করুণ বর্ণনা দিয়েছেন। ‘শরণার্থীদের মুখে এবং জীবনে নানাভাবে দুঃখ-দুর্দশা খোদাই হয়ে আছে। মায়ের কোলে ঘুমন্ত পুষ্টিহীন কঙ্কাল শিশু যে কোনো সময় খাবার ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে পারে’।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৯ জন কর্মচারী মার্কিন সরকারের নীতির বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিবাদ করেন তার বার্তায় তারা স্বাক্ষর করেন। ‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র দমনের নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার গণহত্যার সমালোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।’(পৃষ্ঠা নং ৭১)
অপরদিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণের জন্য ও মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও হেনরী কিসিঞ্জার পাকিস্তানে জাহাজে জাহাজে অস্ত্র পাঠায়। দেশি-বিদেশি সূত্র মতে, মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ লোক নিধন ও দুই লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রমহানীর দায় যুদ্বাপরাধী পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরী কিসিঞ্জার এই অপরাধের দায়ভার কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
তাই বলতে হয়, লেখক ড. নূরুন নবীর তথ্য-উপাত্তে সমৃদ্ব ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধ ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন- ড. কিসিঞ্জারের দায়’ শীর্ষক নামাঙ্কিত বইটি যথার্থ অর্থেই নামের সার্থকতা বহন করে। চমৎকার ভাষাশৈলী ও রেফারেন্স তথ্যে ভরপুর বইটি পাঠকদের নিঃসন্দেহে নানা অজানা তথ্যে ও বোধে সমৃদ্ধ করবে।
পর্যালোচনাকারী : বাবুল চন্দ্র সাহা,
গ্রন্থাগারিক, সরকারি তিতুমীর কলেজ