বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেছে। তারপরও এ খাতটি একের পর এক সন্ধিক্ষণের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রযুক্তিচালিত বিশ্ব বাজারে নিত্য নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং এগুলোর প্রয়োগ বৈশ্বিক ফ্যাশন বাজারে খুচরা বিক্রয় এবং বিতরণকে ব্যাহত করছে, যা যুগপৎভাবে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ, দুটোই সৃষ্টি করেছে।
ভার্চুয়াল কানেক্টিভিটির এই যুগে, সব বয়সের মানুষ, বিশেষ করে জেনারেশন-জেড (জুমারস প্রজন্ম) ভার্চুয়াল জগতে বেশি করে সময় কাটাচ্ছে। এই উদীয়মান প্রজন্মটি ফ্যাশন নিয়ে কি ভাবছে, পণ্য পছন্দের সময় কোন কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তা ফ্যাশন এবং বিলাসবহুল পণ্য নিয়ে কাজ করার সময় বিবেচনায় রাখতে হবে। ফ্যাশন শিল্পের জন্য এটি একটি নতুন সুযোগও তৈরি করেছে, কারণ ভোক্তারা ক্রমবর্ধমানভাবে ডিজিটাল কেনাকাটার দিকে ঝুঁকছে।
প্রকৃতপক্ষে আমরা কোভিড-১৯ মহামারির সময় লক-ডাউন চলাকালে ভার্চুয়াল মার্কেটপ্লেসের তাৎপর্য ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। একই সময়ে, আমরা এটিও বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের নীতি ব্যবস্থার পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত ব্যবসায়িক মডেলে (ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা সহ) কিছু অসঙ্গতি এবং সংযোগ-বিচ্ছিন্নতা ছিলো, যা সেই মুহূর্তের সুযোগগুলো গ্রহণ করা আমাদের জন্য কঠিন করে তুলেছিলো। নিয়ন্ত্রক কাঠামো থেকে উদ্ভূত সীমাবদ্ধতা, বিশেষ করে আন্তঃসীমান্ত লেনদেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা নীতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাগুলো, পোশাক শিল্পের জন্য ক্রমসম্প্রসারণশীল বৈশ্বিক ই-কমার্স বাজারে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
২০১৮ এর জাতীয় ডিজিটাল বাণিজ্য নীতি শুধুমাত্র দেশীয় বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেই প্রণীত হয়েছে এবং এখানে আন্তর্জাতিক ই-কমার্সে প্রবেশের জন্য কোনো সুস্পষ্ট নীতি কাঠামোর উপস্থিতি নেই। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, বৈশ্বিক অর্থপ্রদানের গেটওয়ের অনুপস্থিতি, কার্যকরী মূলধনের অর্থায়ন নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ, ছোট অর্ডারের জন্য কষ্টকর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ, এবং একটি অব্যবহারিক রিটার্ন নীতি (যেখানে রিটার্নকে আমদানি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়) প্রভৃতি বিষয়গুলো একটি শক্তিশালী ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এই চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনা করে, বিজিএমইএ বাংলাদেশের টেক্সটাইল এবং পোশাকখাতের জন্য উপযোগী একটি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম তৈরির অগ্রদূত হিসাবে একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ উন্মোচন করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে ডিজিটালাইজ করার জন্য বাজার সম্ভাবনা এবং এ ব্যাপারে খাতটির প্রস্তুতি চিহ্নিত করা হয়েছে। গবেষণাটি নীতি ঘাটতিসহ টেকসই ব্যবসায়িক মডেল এবং মার্কেটপ্লেসের সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশলগুলোর প্রস্তাব করেছে। প্রতিবেদনে পোশাক খাতের টেকসই সাফল্যের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ন কৌশলগত পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া হয়েছে: (১) এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো উদীয়মান বাজারে বর্তমান ব্যবসা-থেকে-ব্যবসা (B2B) কার্যক্রমের সম্প্রসারণ এবং (২) বাংলাদেশী প্রস্তুতকারক এবং চূড়ান্ত ভোক্তাদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ (B2C) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অতিরিক্ত মূল্য তৈরি করা, যার ফলে উচ্চতর লাভের মার্জিন এবং ব্যবসার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অধিকন্তু, প্রতিবেদনটি স্থানীয় প্রস্তুতকারী, ব্যবসায়ী এবং উদীয়মান বাজারে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে স্টক লটের জন্য একটি কেন্দ্রীয় হাব হিসাবে ভার্চুয়াল মার্কেটপ্লেসের কাজ করার সম্ভাবনাকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছে। যেহেতু গবেষণায় বৈশ্বিক অর্থপ্রদানের গেটওয়ের অনুপস্থিতি, কার্যকরী মূলধনের অর্থায়ন নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ, ছোট অর্ডারের জন্য কষ্টকর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এবং রিটার্ন নীতির মতো বিভিন্ন বিষয় ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে এবং বিজিএমইএ সফলভাবে বিষয়গুলো সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়, যার ফলশ্রুতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভার্চুয়াল মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে রপ্তানি নীতি ২০২১-২৪ এ বলেছে, “অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং ভার্চুয়াল মার্কেট প্লেস প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদান করা হবে। (সাব ক্লজ ২,৩,৩৭)।” প্রতিবেদনটি ভার্চুয়াল বাজারে আমাদের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে আমাদের অগ্রযাত্রায় আমাদের শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হিসাবে কাজ করবে। আমি আশা করি যে নীতিনির্ধারক এবং উদ্যোক্তারা পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য এর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবেন এবং এর জন্য লজিস্টিকস এবং ডিস্ট্রিবিউশন, ব্র্যান্ডিং এবং বৈদেশিক মুদ্রা এবং রাজস্ব নীতিসহ নির্দিষ্ট বিষয়গুলোতে আরও গবেষণার প্রয়োজন হতে পারে। আমরা যদি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে চাই, তাহলে আমাদের একটি ব্যাপক ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করতে হবে। এই প্রতিবেদনটি আমি বিশ্বাস করি, ডিজিটাল জগতে আমাদের উপস্থিতি কেবল যে সহজভাবে বাড়িয়ে তুলবে, তা নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যত ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রচেষ্টার জন্য একটি গাইড ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবেও কাজ করবে।
ফারুক হাসান সভাপতি, বিজিএমইএ