পৃথিবীর যা মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
সাম্য ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত এই দুটি কবিতার লাইনের মাধ্যমেই এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে যে পৃথিবীর যেকোনো দেশ, রাষ্ট্র বা সমাজ গঠনের আন্দোলনে, সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে, সংস্কৃতির বিকাশে তথা সকল ইতিবাচক বা জনহিতকর কাজে শুধু নির্দিষ্ট একটি লৈঙ্গিক শ্রেণি অর্থাৎ পুরুষ সমাজ প্রতিনিধিত্ব করে না বরং প্রতিনিধিত্ব করে মানুষ যেখানে একজন পুরুষের যতটুকু অবদান থাকে একজন নারীরও ঠিক ততটুকু অবদান থাকে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সমাজ বা রাষ্ট্রের ন্যায় সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা বাংলাদেশেরও রয়েছে অনেক গৌরবময় ইতিহাস। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরাবান্বিত ও স্মরণীয় ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এটি ছিল একটি পরিপূর্ণ জনযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙ্গালি মুক্তিকামী জনগণ ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে আমরা যে বিজয় অর্জন করি এই বিজয় আমাদের জন্য যতটা আনন্দের পাশাপাশি ছিল আমাদের জন্য বেদনার ও দুঃখের। কেননা অনেক প্রাণের বিসর্জন ও রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছিলাম বাংলাদেশ নামক এই সুন্দর রাষ্ট্র। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন আলোচনা, গবেষণা, চলচ্চিত্র, সাহিত্যে পুরুষদের অবদানের কথা যতটা জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, নারীদের ভূমিকার কথা সেভাবে উপস্থাপিত হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে অনেক সাহসী নারী রণাঙ্গনে শত্রুবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়, আশ্রয় ও খাবার প্রদান, গুপ্তচর হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শত্রুপক্ষ সম্পর্কে তথ্য দেয়ার মতো দুঃসাহসিক কাজে জড়িত ছিলেন তারা।
তারামন বিবি, কাকন বিবি, সিতারা বেগম, করুণা বেগম, রওশন আরা, কাঞ্চনমালাসহ নাম না জানা আরও অনেক নারীর দুঃসাহিক প্রচেষ্টার দরুণ আমরা অর্জন করেছি আমাদের প্রচন্ড ভালোবাসা, অহংকার ও সম্মানের লাল সবুজের পতাকা। তাই মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে অবশ্যই এসব মহীয়সী নারীর ত্যাগ, তিতিক্ষা ও অবদানের বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা কয়েকজন নারী মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধকালীন সাহসিক অবদানের কথা নিম্নে আলোকপাত করা হলঃ
কাকন বিবি
কাকন বিবি যার পুরো নাম কাঁকাত হেনিনচিতা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন দুঃসাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা। এই নির্ভীক নারীর মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি মুক্তিবেটি বা অগ্নিকন্যা নামে পরিচিত। খাসিয়া সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া এই আদিবাসী নারী ৫নং সেক্টরের অধীনে শত্রুবাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করেন।মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এই নারীর যুদ্ধ করার কথা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তার স্বামী তৎকালীন ইপিআর সদস্য মজিদ নিরুদ্দেশ হলে তিনি স্বামীকে খুঁজতে পাকিস্তানি বিভিন্ন ক্যাম্পে যান। ক্যাম্পগুলোতে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের থেকে সহযোগিতা পাওয়ার পরিবর্তে তাদের পুরুষতান্ত্রিক লালসার শিকার হন তিনি। এসময় তার বোন জামাইও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হয়। “অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর” এই প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে কাকন বিবির মধ্যে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে তিনি মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচর হিসাবে শত্রুনিধনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন ছদ্মবেশে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ সম্পাদন করতে থাকেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি আরেক দফায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হন। এবারের নির্মমতা হার মানায় পূর্বের নির্মমতাকেও। টানা ৭ দিন পাকিস্তানি নরপশু কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। কিন্তু এই নির্যাতনও দেশমাতৃকার প্রতি তার ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতাকে টলাতে পারেনি। নতুন উদ্যমে নিজেকে শানিত করতে থাকেন দেশমাতৃকার সংগ্রামে। আগস্টের শেষের দিকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। প্রায় ২০ টির মতো সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধগুলোতে অংশ নিতে গিয়ে তিনি পায়ের উরুতে গুলিবদ্ধ হন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই ক্ষত বহন করেন। ১৯৯৭ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বাদ পাওয়ানো এই দুঃসাহসিক মহীয়সী নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পেলেও গেজেট জটিলতায় বীরপ্রতীক খেতাবের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।তাই মৃত্যকালে একপ্রকার হতাশা নিয়ে নীরবে নিভৃতলোকে গমন করেন কাকন বিবি।
তারামন বিবি
তারামন বিবি যার পুরো নাম তারাবানু ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে অংশ নেয়া একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র ১৩ বছর বয়স যে বয়সে বিশ্বজগতের অনেক জটিল-কঠিন বিষয় কৈশোর মনে থাকে অজ্ঞাত ঠিক সেই সময়ে সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম জেলার এই মহীয়সী নারী।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১১নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহিব হাবিলদারের ধর্ম মেয়ে হিসাবে তারামন বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের খাবার রান্না ও ধোয়া-মোছার দায়িত্ব নেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ দেখে তাকে অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারামন ১১নং সেক্টরের অধীন মোহনগঞ্জ, তারাবর কোদালকাটি, গাইবান্ধার ফুলছড়িসহ বহু সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে তারামন বিবি অত্যন্ত সাহসিকতা ও কৃত্বিতের সাথে গুপ্তচরবৃত্তির কার্য সম্পাদন করেন। কখনও ভিক্ষুক বা কখনও পাগলের বেশে তিনি নিষ্ঠার সাথে গুপ্তচরবৃত্তির কাজ সম্পাদন করেন। যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্বকালীন তার বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন। কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাওয়ায় তারামন বিবি এই খবর জানতে পারে নি। শেষমেষ ১৯৯৫ সালে তার সন্ধান পাওয়া গেলে তার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বীরপ্রতীক সম্মাননা দেয়া হয়।
২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকগমন করেন মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এই মহীয়সী নারী।
সিতারা বেগম
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা আরেক সাহসী নারী ক্যাপ্টেন ডা.সিতারা বেগম। শুধু রণাঙ্গনে অস্ত্র চালনা করেই নয় বরং নিজের পেশাকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধকালীন শরণার্থী রোগীদের সেবাশুশ্রূষার মধ্য দিয়েও দেশমাতৃকার যুদ্ধে অবদান রাখা যায় তা প্রমাণ করেছে এই মহীয়সী নারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্তমান গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা.জাফর উল্লাহ ও দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের তত্ত্বাবধানে ভারতের আগরতলার মেঘালরে নির্মিত বাংলাদেশ হাসপাতালের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শরণার্থী রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন এই কর্মনিষ্ঠ নারী। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই হাসপাতালের মানবিক চিকিৎসক হিসাবে তার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এমনকি বিজয়ের দিনও কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের সংবাদ জানতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে যুদ্ধকালীন অসামান্য অবদানের জন্য এই মহীয়সী নারী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর প্রতীক' খেতাবে ভূষিত হন।
আশালতা বৈদ্য
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ে একজন দুঃসাহসিক নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আশালতা বৈদ্য। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যোদ্ধা হিসাবে তার সাথে অন্যান্য নারীদের মিল থাকলেও যুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অন্যান্য দের থেকে ব্যতিক্রম। কেননা তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ একমাত্র নারী কমাণ্ডার যার অধীনে ৩৪৫ জন মহিলা যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষিত হয়।
যুদ্ধের শুরুতে আশালতা ও তার আরও দুই বোনের প্রতি লোলুপদৃষ্টি পড়ে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর।তারা আশালতার পিতার কাছে ছয় লাখ টাকা দাবি করে। টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার তিন মেয়েকে তুলে নেয়ার হুমকি দেন। এসময় হেমায়েত বাহিনীর প্রধান প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন আশালতাকে যুদ্ধে নেওয়ার জন্য তার বাবা-মার সম্মতি চান। শুরু থেকেই অধিকার সচেতন আশালতা এই প্রস্তাবকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনিসহ আরো ৪৫ জন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে তিন মাস প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
প্রশিক্ষণ শেষে আশালতা ও তার অন্যান্য নারী মুক্তিযোদ্ধারা হেমায়েত বাহিনী ও কমলেশ বাবুর কমাণ্ডে অনেকগুলো সম্মুখ যুদ্ধ সাফল্যের সাথে পরিচালনা করেন। আশালতার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে হেমায়েত বাহিনী নারী কমান্ডো গড়ে তুলেন।যেখানে আরো ৩০০ জন নারী অংশগ্রহণ করেন। আর এদের কমাণ্ডার ছিলেন আশালতা বৈদ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনের একমাত্র নারী কমাণ্ডার হয়ে শত্রুবাহিনীর সাথে লড়ে যাওয়া এই সাহসী নারী কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি।
শিরিন বানু মিতিল
শিরিন বানু মিতিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা, অবদান ও কার্যক্রমের জন্য তাকে বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ প্রীতিলতা ওয়েদ্দারের সাথে তুলনা করা হয়। পাবনায় রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেয়া এই নারী মুক্তিযোদ্ধা শুরু থেকেই ছিলেন রাজনীতি তথা অধিকার সচেতন। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকায় আক্রমণ করার পর সারাদেশেই তাদের মিলিটারি ক্যাম্প স্থাপন করে আক্রমণ শুরু করে। এর ব্যতিক্রম ছিল না পাবনা। ২৫ মার্চের পরেই পাবনা জেলাও শত্রুবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। সর্বপ্রথম ২৭ মার্চ শত্রুবাহিনীর অন্যায়মূলক আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণে যায় পাবনার সর্বস্তরের জণগণ। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন শিরীন বানু মিতিল। তবে তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছিল কঠিন ও জটিল ব্যাপার। তাই তিনি পুরুষের ছদ্মবেশে উক্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ২৮ মার্চ পাবনার টেলিফোন এক্সচেঞ্জে পাবনার জনতার সাথে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হলে সেখানেও অংশ নেন এই সাহসী নারী। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর পর্যায়ে পুরুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে একের পর এক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা মুক্তিযোদ্ধা মিতিলের ছবি ভারতের একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এতেই দমে যান নি মিতিল। দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে তিনি ভারতে যান। সেখানে বাংলাদেশের সরকারের পরিচালনায় গঠিত নারী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প(গোবরা ক্যাম্প) এ যোগ দেন। সেখানে অন্যান্য নারী যোদ্ধাদের পাশাপাশি তিনি যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কিত কৌশল আয়ত্ত করেন। শিরীন বানু মিতিল মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার পক্ষ নিয়ে অবদান রেখে গেছেন। তিনি সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যোগদান করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে থাকেন।কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য নারী মুক্তিযোদ্ধার মতো এই মহীয়সী নারীও পরিপূর্ণ সম্মানের অভাবে অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যান।
করুণা বেগম
মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আরেক অকুতোভয় নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম করুণা বেগম। তার স্বামী শহীদুল হাসানও ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিহত হন তিনি। স্বামীর মৃত্যর পর শোকে বিহ্বল না হয়ে তিনি শোক থেকে শক্তি সঞ্চার করে মাত্র তিন বছরের শিশুকে বাসায় রেখে দেশমাতৃকার টানে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে উক্ত বাহিনীর ৫০ জন নারীযোদ্ধার কমাণ্ডার হন তিনি। করুণা বেগম ও তার অন্যান্য সহযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে শত্রুবাহিনীর বিপক্ষে দুঃসাহসিক অপারেশন পরিচালনা করেন। এমনি এক যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলি তার পায়ে বিদ্ধ হয়।মৃত্য অবধি তিনি ক্রাচে ভর করে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,যে নারী তিন বছরের শিশুর মায়া ত্যাগ করে, দেশ ও দেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করে যুদ্ধে অবদান রেখে গিয়েছিলেন, যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বিবেচিত হয়েছে উপেক্ষিত হিসাবে।
উপরি উল্লিখিত নারী মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়াও আরো অনেক নারী ছিল যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাষ্ট্র ঘোষিত সম্মাননা তথা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হতে বাদ পড়েছে। এদের অনেকেই বুকে চাপা দুঃখ, কষ্ট নিয়ে মৃত্যবরণ করেছেন মনুষ্যলোক থেকে এবং আরো অনেকে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রত্যাশিত সম্মাননা বা স্বীকৃতি তা পেয়ে দৈন্যতার সাথে লড়াই করছেন। তাই রাষ্ট্রের উচিত হবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা সকল নারী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে তাদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়িত করা।
অর্নব প্রসাদ কাজ্জী, শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়