প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

শিক্ষকের অমর্যাদা তো বাংলাদেশেরই অমর্যাদা

সোহেল রানা
০৭ জুলাই ২০২২ ১৪:৫৬:৪৯ | আপডেট: ১ year আগে
শিক্ষকের অমর্যাদা তো বাংলাদেশেরই অমর্যাদা

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষককে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে/ কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-/ ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির/ সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’

শিক্ষাগুরুর মর্যাদা– কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত এই কবিতা পড়েনি এমন বাঙালি ছাত্র/ছাত্রী খুব কমই আছে। ছেলেবেলায় পড়া এই কবিতা এতোটাই মাথায় গ্রথিত হয়ে আছে যে, এখনও শিক্ষাগুরুর সাথে দেখা হলে বাদশাহ্ আলমগীর ও তার পুত্রের দেয়া শিক্ষকের প্রতি সম্মানের কথা মনে পড়ে যায়। আর তাঁদের সামনে আমাদের মাথাও শ্রদ্ধায় নতো হয়ে যায়। তাঁদের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলা তো দূরের কথা, সাধারণ কুশল বিনিময় করতে গিয়েও পা কাঁপে! এটা ভয়ে নয়; বিনয়ে, সম্মানে আর কৃতজ্ঞতায়!

কেননা, আমাদের জীবন গড়ার এই শিক্ষাগুরুদের গুরুদক্ষিণা দেবার সামর্থ্য আমাদের কারও নেই, যতই আমরা বিত্তবান হই না কেন, যত বড় বড় পজিশনেই চাকরি করি না কেন, আমাদের শিক্ষকদের অবস্থান সবার উপরে। তাঁদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নাই, শোধও হবে না কোনো দিন।

কবি কাজী কাদের নেওয়াজও তার উপরের কবিতার মধ্য দিয়ে শিক্ষকের শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মান সম্পর্কে আলোকপাত করেন। শিক্ষকদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার পরেই! হযরত মুহাম্মদ(সঃ)বলেন, আল্লাহর পরে, রাসুলের পরে ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব, যে বিদ্যার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে (বুখারি :৪৬৩৯)’। রসুল (সঃ) নিজেই ঘোষণা করেছেন- 'শিক্ষক হিসেবে আমি প্রেরিত হয়েছি (ইবনু মাজাহ : ২২৫)।

সত্যিই তো, সমাজের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকের সম্মান সর্বোচ্চ ও সবার ঊর্ধ্বে থাকার কথা। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক হবার কথা শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, শাসন-স্নেহের আর নিঃস্বার্থ। এটাই আমাদের সমাজের মূল্যবোধ। এসব পড়ে ও জেনেই আমরা বড় হয়েছি! আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুরাই আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তুলে মনুষ্যজীব হিসাবে আমাদেরকে পূনর্জন্ম দিয়েছেন। শিখিয়েছেন কীভাবে সভ্য সমাজ গড়তে হয় আর সেই সমাজে বাস করতে হয়।
কিন্তু ইদানিং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু উদ্বেগজনক সংবাদ জাতিকে নাড়া দিয়েছে। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা এরকম:

‘শিক্ষকের গলায় জুতার মালার ঘটনায় নড়াইলের ডিসি-এসপির বিচার দাবি’ (প্রথম আলো, ২৭ জুন ২০২২)।

‘শিক্ষকের গলায় জুতার মালা জাতির চরম অসভ্যতার পরিচয়: পরিকল্পনামন্ত্রী (১ম জুলাই ২০২২, যমুনা টেলিভিশন)’।

‘শিক্ষক উৎপলের মৃত্যু ১৭ কোটি মানুষের জন্য লজ্জার-অপমানের’ (প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০২২)।

উপরের সংবাদ শিরোনাম থেকে বোঝাই যায়, আমরা সভ্যতার কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি! এমন এক সমাজ তৈরি হয়েছে যেখানে একজন ছাত্র কিংবা ক্ষমতার নানা অবস্থানে বসে থাকা কিছু অপদার্থ সম্মানিত শিক্ষকের গলায় ফুলের মালা না পরিয়ে, পরাচ্ছে জুতার মালা! আর তাদেরই কেউ কেউ আবার শিক্ষককে পিটিয়ে মেরেও ফেলছে।
মৃত শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘যে শিক্ষার্থীকে আমরা ক্লাসে পড়াই, যে শিক্ষার্থীকে আমরা আলোকিত করি......, সেই শিক্ষার্থীর আঘাতে আমাদের মৃত্যুবরণ করতে হবে, এর চেয়ে লজ্জার, দুঃখের, ঘৃণার, অপমানের আর কিছু হতে পারে না। এ অপমান, এ লজ্জা......শুধু শিক্ষক সমাজের নয়; এ অপমান, এ লজ্জা বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের।’

উৎপল হাজি ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন। গত ২৫ জুন দুপুরে দশম শ্রেণির এক ছাত্র ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে অতর্কিত হামলা চালায় শিক্ষক উৎপলের ওপর। গতকাল সোমবার ভোরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় উৎপল মারা যান। হামলাকারী ছাত্রের বিরুদ্ধে উত্ত্যক্তের অভিযোগ দিয়েছিল এক ছাত্রী। হামলাকারী ছাত্র বিদ্যালয়ের সভাপতির আত্মীয় (প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০২২)।

বাতির নিচে যে দিন দিন অন্ধকার জমা হচ্ছে, সভ্যতার উন্নয়নের নিচে যে বর্বরতার চর্চা হচ্ছে, এইসব ঘটনা তারই প্রমাণ বহন করে। সামগ্রিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে আমরা যে একটি নগ্ন-নোংরা-পিছিয়ে পড়া সভ্যতা, মোটা দাগে অসভ্যতা বহন করে চলেছি—এসব ঘটনা তারই প্রমাণ।

আমাদের দেশে একটা সময় পর্যন্ত সমাজের আদর্শ মানুষ হিসেবে শিক্ষকদের মর্যাদা দেয়া হতো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাঁদের কথা মেনে চলতেন। শিক্ষকেরা ছিলেন সমাজের মগজ, ছিলেন জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। শিক্ষকতা পেশা ছিল অনেকের ব্রত ও আরাধ্য। কারণ সমাজের প্রায় সবাই মানতো যে, আলোকিত না হলে সত্যিকার মানুষ হওয়া যায় না।

কিন্তু আমাদের সমাজে দিনে দিনে আলোটা ফিকে হতে শুরু করেছে। এখন সমাজে, সমাজ নিয়ন্ত্রণে, ক্ষমতার নানা অবস্থানে এমন সব মানুষ আছে, যারা মানুষ-অমানুষ পার্থক্যটাও বোঝে না। ধর্ম-অধর্ম-বিজ্ঞান এর মিল-অমিলও বোঝে না। ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তুলে কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনা তারই এক জ্বলন্ত প্রমাণ।

নড়াইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষকের গলায় যে জুতার মালা পরালেন, তাতে কে বা কারা অপমানিত হলেন? আমার তো মনে হয়, যারা পরিয়েছেন তারা নিজেরাই হয়েছেন। কেননা তাদেরকেও তো কোন না কোন শিক্ষক পড়িয়েছেন। বর্ণপরিচয় শিখিয়েছেন। নইলে তারা এই পজিশনে আসলেন কি করে? সত্যি বলতে, শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো বাংলাদেশের গলায়ই জুতার মালা পরানোর শামিল।

যখন কোন সমাজের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা স্বার্থকতা আর সাফল্যের পার্থক্যই শেখাতে পারে না; জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, সৃষ্টিশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধের উৎকর্ষতা-এসবের নিরিখে যখন আর সাফল্য মাপা হয় না; তখন সেই শিক্ষাব্যবস্থা শুধু অর্থ, ক্ষমতা অর্জন আর টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ত করা শেখাতে পারে; দিতে পারে শুধু সার্টিফিকেট সর্বস্ব ডিগ্রি আর পছন্দের ক্যাডারশিপ। কিন্তু তৈরি করতে পারে না গবেষক, চিন্তক বা বুদ্ধিজীবী কিংবা আহমদ ছফাদের। বলা যায়, তৈরি করার প্রয়োজনবোধ করে না। তখন আর সেই সমাজে মানুষ গড়ার কারিগরদের প্রয়োজনটাও ফুরিয়ে যায়।

এখানে সুলেখক আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটি থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রাজ্জাক স্যার বলেছেন, ‘বেঙ্গলের সবচাইতে মিসফরচুন ব্যাপার অইল, এইখানে সাপোর্টিং কলেজ অওনের আগে য়্যুনিভার্সিটি তৈয়ার অইছে। আর মিডল স্কুল তৈয়ার না কইরা কলেজ বানাইছে। শুরু থেইক্যাই বেঙ্গলের এডুকেশন সিস্টেমটা আছিল টপ হেভি।’

‘বাঙালিদের যে রকম ডিগ্রির ক্রেজ, এইডা নতুন কোনো কিছু নয়। কলেজ তৈরি করার আগে ইউনিভার্সিটি তৈয়ার করার কারণে এই ক্রেজ জন্মাইছে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাইরে ইন্ডিয়ার অন্য কোনো অঞ্চলে এই ক্রেজ পাইবেন না।’
বর্তমানে আমাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থা আর সেটার ‘আফটার-এফেক্ট’ লক্ষ্য করলেই এই কথাটার মর্মার্থ সহজেই অনুভব করা যায়। মিডল স্কুলের সূত্র ধরেই রাজ্জাক স্যার বলছিলেন, ‘গ্রেট ব্রিটেনে বাজেটে ডিফেন্সের চাইতে এডুকেশনে বেশি অর্থ এলট করা হয়।’

এখানে দাবি রাখতে চাই, আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সিলেবাসে শিক্ষাগুরুর প্রতি শিষ্যের এবং শিষ্যের প্রতি শিক্ষাগুরুর দায়িত্ব ও কর্তব্য কী, তাদের মধ্যে সম্পর্কের স্বরূপ কেমন হওয়া দরকার ইত্যাদি নিয়ে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্ট যুক্ত করা হোক। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, ইতিহাস আর সাহিত্যের পাতা থেকে নৈতিক জ্ঞানের আরও কার্যকরী ও সুপাঠ্য বিষয়বস্তু যুক্ত করা হোক।

জাতির এই ক্রান্তিকালে ভালো শিক্ষকদের মত পাঞ্জেরি ও কাণ্ডারি খুবই প্রয়োজন। সেইসাথে শিক্ষক নির্যাতন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপও নিতে হবে। কেননা শিক্ষক নির্যাতনের মত ঘটনা সমাজে যে মূল্যবোধের, সভ্যতার, মানবিকতার সংকট সৃষ্টি করছে, তা জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। মূল্যবোধ ও সভ্যতার এই সংকট জাতি হিসাবে আমাদের করে তুলবে হীন, দীন! যতই আমরা উন্নয়নের ইমারত গড়ে তুলি না কেন, তা দিনশেষে কোন কাজেই আসবে না।

আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার যথার্থই বলেছেন, ‘এখন যারা শিক্ষক নির্যাতনসহ সব অন্যায় অবিচারকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, ভাবছেন তাদের সন্তানেরা থাকবে দুধে–ভাতে, আমেরিকা-কানাডায়, দয়া করে দ্বিতীয়বার ভাবুন। যেসব আলামত আমরা দেখছি, তা যে সংকট সৃষ্টি করবে মূল্যবোধের, সভ্যতার, মানবিকতার, তা একটা প্রবল স্রোতের মতো সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বিদেশও এখন আর নিরাপদ নয়। বিপদ সবখানেই। তার চেয়ে বরং দেশটার দিকে তাকাই। দেশ তো সেই একটাই’।

সোহেল রানা
লেখক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী