প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

সব প্রশ্ন করা যায় কি?

০৩ এপ্রিল ২০২১ ২০:০৫:৫৬ | আপডেট: ৩ years আগে
সব প্রশ্ন করা যায় কি?

ডা. পলাশ বসু

 

করোনাকালে এখন অনেক কিছুর সমন্বয়ে একটা ভয়ের কাল হয়ে উঠেছে। আমরা মহামারি নিয়ে এখন যতটা ভীত, তার চেয়েও বেশি ভীত মানুষরূপী ভাইরাসের দৌরাত্মে। আমাদের জীবন-মরণ সবকিছু এখন এসব ভাইরাসরূপী মানুষদের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি প্রয়াত হাবিবুর রহমান সাহেবের কথা এখন আবার নতুন করে মাথায় আসছে, দেশ আজ বাজিকরদের দখলে!

আগে অসুস্থ হলে উপরতলার মানুষেরা যেতেন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, আমেরিকাতে চিকিৎসার জন্য। নিদেনপক্ষে ইন্ডিয়া। একটু সর্দি-কাশি হলেই দৌড় মারতেন। তারপর দেশে এসে পাঁচতারকা হোটেলসদৃশ সেসব চিকিৎসাসেবার গুণকীর্তন করতেন। কত টাকা খরচ হলো সেটা কিন্তু বলেন না। যাই হোক, এ দেশের ডাক্তার থেকে শুরু করে সবই খারাপ বলে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে গালমন্দ করতেন। তারপর একদিন উনারা হয়তো মনে মনে ভাবলেন যে, গালমন্দ করলেই শুধু হবে না। নিজেদের চিকিৎসার জন্য দেশেও অমন পাঁচতারকা হোটেল কাম চিকিৎসা কেন্দ্র খুলতে হবে। তারা তা খুললেনও। সেটা খুলুক তারা। এটা দোষের তো নয়। অন্তত সেটাও মন্দের ভালো বলে আমরা ধরে নিতে পারি। কারণ গরিবের চিকিৎসা না হলেও সেখানে কিছু ভিআইপিদের চিকিৎসা তো হয়। তাতে দেশের টাকা দেশেই থেকে যায়। এতে লাভ হয় দেশেরই।

তবে করোনা এসে দেখলাম সে পরিস্থিতিতেও পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ভিআইপিরা এখন বিদেশ যেতে পারবে না (আসলে কোনো দেশ তো নিচ্ছে না চিকিৎসা দেওয়ার জন্য)। আবার দেশের ওই পাঁচতারকা হোটেল হাসপাতালগুলোতেও তারা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন না। কেন যাচ্ছেন না তা জানি না৷ তাহলে তারা কোথায় যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে? যাচ্ছেন সিএমএইচ-এ। আমি এটাকেও খারাপ বলছি না। কারণ চিকিৎসার জন্য দেশে ভালো হাসপাতাল থাকাটাই শ্রেয়। খুব ক্রিটিক্যাল রোগী যার চিকিৎসা কোনো কারণে দেশে সম্ভবপর নয়, তাকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতেও কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? বিষয়টা দাঁড়াল যে, ভালো চিকিৎসাকেন্দ্র মানে হচ্ছে একটা ভালো ব্যবস্থাপনা। সিএমএইচ সেই ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ সাধনে কোনো ছাড় দেয় না। বাইরের কেউ গিয়ে হম্বিতম্বি করার সুযোগ নেই সেখানে। এখন উন্নত দেশের কথা বাদ দিন; দেশের মধ্যে সিএমএইচকেই যদি আপনি আদর্শ মানেন, তাহলে তো হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা তেমনই হওয়া উচিৎ। নয় কি?

কিন্তু গণমানুষের জন্য তৈরি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার আসল অবস্থা কেমন, তা কি আমরা জানি? লোকবল, যন্ত্রপাতি, হাসপাতালের পরিবেশ-এসব নিয়ে আমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি যে কতটা ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের এ স্বাস্থ্যব্যবস্থা চলছে! কতটা কষ্টকর পরিবেশে স্বাস্থ্যকর্মীরা এতদিন চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসতেম, সেটা ভেবেছি কখনো? নাকি পুরো ব্যর্থতার দায়ভার এসব স্বাস্থ্যকর্মীদের (মূলত ডাক্তার) উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের গায়ে হাত তুলে নিজেদের বাহাদুরি দেখাতে আমরা ব্যস্ত থেকেছি?

আমরা প্রাইমারি স্বাস্থ্যে অনেক অর্জন করেছি ঠিকই, কিন্তু একটা সমন্বিত সুন্দর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা দাঁড় করানোর জন্য আজ অবধি আমরা কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। এ কারণে গুণগত চিকিৎসা পেতে প্রতি ১০ হাজারে যেখানে স্বাস্থকর্মী (ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান ইত্যাদি) থাকার কথা ৪৪.৫ জন, সেখানে আমাদের আছে ৮.৩ জন। প্রায় সাড়ে ৫ গুণ কম! আবার এর ভেতরে চিকিৎসক, নার্স এবং টেকনিশিয়ানের অনুপাত থাকার কথা ১:৩:৫। অর্থাৎ ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে ৩ জন নার্স এবং ৫ জন টেকনিশিয়ান থাকার কথা। আর আমাদের এখানে এ অনুপাত কত জানেন? এটা হচ্ছে ১:.৬:.৩। মানে ১ জন চিকিৎসকের বিপরীতে নার্স আছেন দশমিক ৬ এবং টেকনিশিয়ান আছেন দশমিক ৩ জন। বুঝেন তাহলে অবস্থা! এ তথ্য ২০১৯ সালে সরকারের মিনিস্ট্রি অব হেল্থ এন্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার এর প্রকাশিত তথ্য থেকে নেওয়া।

এখন আপনি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করুন, সরকারি হাসপাতালে গেলে আপনি কিভাবে আপনার মনঃপুত চিকিৎসা পাবেন? কিভাবে আপনি সুন্দর পরিবেশে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবেন বলেন? এই যে উপরতলার মানুষদের কথা বলছিলাম তারা তো আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই অবস্থার কথা জানেন না তা তো নয়। তাহলে দেশের অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিকে তারা তাহলে গুরুত্ব দেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর না হয় কষ্ট করে নিজে নিজেই একটু খুঁজতে থাকুন।

আর করোনাকালের শুরুতেই যে মাস্ক, পিপিই কেলেঙ্কারি দেখলাম, তার জের শেষ হতে না হতেই জিকেজির কেলেঙ্কারি বের হলো। এখন বের হলো রিজেন্ট হাসপাতালের কেলেঙ্কারি। এর মালিককে টকশোতে দেখতাম বেশ বোল্ডলি কথা বলতে। এখন একি দেখছি? আবার শুনছি এ হাসপাতালের নাকি সরকারের অনুমোদন নেওয়ার লাইসেন্সের মেয়াদ সেই ২০১৪ তেই নাকি চলে গেছে। মানে লাইসেন্স নবায়নই করেনি। তাহলে তার সঙ্গে চুক্তি হলো কিভাবে? মোটা মাথায় সে প্রশ্ন এলেও তা করতে একটু দ্বিধান্বিতই হয়ে পড়ছি। কারণ, ঘাড়ে মাথা তো সবার মতো আমারও একটাই। সব প্রশ্ন তাই করা যায় কি? নাকি তা করাটা যুক্তিসংগত, আপনারাই বলুন?

ডা. পলাশ বসু : চিকিৎসক ও শিক্ষক