প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

সাক্ষরতার হালচাল

০৩ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৫৪:৫০ | আপডেট: ৩ years আগে
সাক্ষরতার হালচাল

মো. জহির উদ্দিন

 

বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৭৭৫ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাক্ষরতা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই। আর ৬০.৭ মিলিয়ন শিশুরা সাক্ষরতার শর্ত পূরণ করার আগেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। সব ধরনের অজ্ঞতা, মুর্খতা, কু-শিক্ষা, ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদীতা, সহনশীলতা বৃদ্ধি, শৃঙ্খলাবোধ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং শোষণ থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষার ভূমিকা সর্বাগ্রে স্থিত।

শিক্ষার গুরুত্বকে অনুধাবন করে সর্বব্যাপী প্রচার করার জন্য ইউনেস্কো ১৯৬৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সর্বপ্রথম জাতিসংঘভুক্ত প্রতিটি দেশ ১৯৬৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে মহাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা দিবস পালন করে। উন্নত প্রযুক্তি, মানুষের জীবনধারা এবং বিশ্বগ্রাম ধারণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাক্ষরতার মানদণ্ড বিভিন্ন সময় বিবর্তিত এবং হালনাগাদ করা হয়েছে।

বঙ্গদেশে সাক্ষরতা শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করতে দেখা যায় ১৯০১ সালের জনসংখ্যা গণনার দলিলে। সাক্ষরতার সংজ্ঞা বা মানদণ্ড দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। এক সময় স্বাক্ষরতা বলতে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন অথবা নিজের নাম লিখতে পারা মানুষকে বোঝানো হতো। কিন্তু এখন এর পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। চল্লিশের দশকে পড়ালেখার দক্ষতা, ষাটের দশকে হিসাব-নিকাশ করার দক্ষতা, আশির দশকে হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতা এবং দৃশ্যমান জিনিশের প্রতি সম্যক ধারণা থাকাকে স্বাক্ষরতা বোঝানো হতো।

বর্তমানে উপরোক্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে ক্ষমতায়নের দক্ষতা, প্রতিরক্ষার দক্ষতা, নির্বাহী দক্ষতা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং যোগাযোগের দক্ষতা যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭০ শতাংশ। কিন্তু এই পরিসংখ্যান সর্বশেষ সাক্ষরতার মানদণ্ডগুলো পূরণ করে কি না, এই নিয়ে প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

জাতিসংঘ ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে যে ১৭টি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, এর চতুর্থস্থানে আছে মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষা বলতে বোঝানো হয়েছে, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পাশাপাশি আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। জাতিসংঘভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করছে জাতিসংঘ ঘোষিত মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে। এই উদ্যোগগুলো হয়ত সাক্ষরতার বা সমতার পরিসংখ্যান বাড়াচ্ছে কিন্তু শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, এটা এখন বিবেচনার বিষয়।

বর্তমানে শিক্ষা অনেকাংশে কোচিং এর হাতের পুতুল; জানার আগ্রহের চেয়ে সংক্ষিপ্ত উপায়ে পাস করাই মুখ্য বিষয় এবং এ নিয়ে অভিভাবকদের নাভিশ্বাস অবস্থা দেখার মতো। দূরদর্শিতার অভাবে মাত্রাতিরিক্ত ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলেও নেই বাস্তব জ্ঞান, সর্বশেষ প্রযুক্তিগত সম্যক ধারণা এবং ব্যবহারিক জ্ঞান। একুশ শতকের সর্বশেষ সংস্করণের সাথে অনেকেই তাল মিলাতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠছে জীবন-ধারনের সম্বল খুঁজে পেতে। অন্যদিকে বাস্তবিক শিক্ষার সর্বশেষ সংস্করণের অভাবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে বা জনমিতিক লভ্যাংশকেও (৬০ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম) কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ, যা শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে এবং শেষ হবে ২০৩৮ সালে।

প্রকৃতির আশীর্বাদ, এই জনমিতিক লভ্যাংশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া এবং জাপান এখন উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সাক্ষরতার সর্বশেষ মানদণ্ডগুলো, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, প্রতিরক্ষায় দক্ষতা, নির্বাহী দক্ষতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, দৃশ্যমান জিনিশের প্রতি সম্যক ধারণা, সচেতনতা এবং যোগাযোগের দক্ষতা ইত্যাদি অর্জন করতে হলে সকল ধরনের অব্যবস্থাপনাকে সংস্কার করে, শিক্ষাকে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিভিত্তিক করতে হবে। আজকের সাক্ষরতা দিবসে এটাই প্রত্যাশা করছি, শিক্ষার সর্বশেষ সংস্করণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনমিতিক লভ্যাংশকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশকে উন্নয়নের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছাতে মোক্ষম ভূমিকা পালন করবে।

মো. জহির উদ্দিন : সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষক ও টিম লিডার, ইচ্ছেঘুড়ি ফাউন্ডেশন, ঢাকা