প্রচ্ছদ ›› রাজনীতি

৩০ ঘটনা তুলে ধরে বিদেশি দূতাবাসে বিএনপির চিঠি

নিজস্ব প্রতিবেদক
০১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:৫৭:৪৮ | আপডেট: ৪ মাস আগে
৩০ ঘটনা তুলে ধরে বিদেশি দূতাবাসে বিএনপির চিঠি

দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পটভূমি এবং আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতাসহ চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গতকাল রবিবার চিঠি দিয়েছে বিএনপি। এতে ৩০টি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-কাঠামোতে, বিশেষত বাসে-ট্রেনে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ পরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে জনগণের জানমাল ও নিরাপত্তা-স্বাধীনতা বিনষ্ট করছে বলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। একই দিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনডিআই ও আইআরআই নির্বাচন পর্যবেক্ষক টিমের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে দেশের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরেছে বিএনপি। এর আগে গত শনিবার কমনওয়েথ এবং এরও কিছুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি।

বিভিন্ন দূতাবাসে দেওয়া চিঠিতে চলমান অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতা বিষয়ে গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দশটি ঘটনা তুলে ধরা হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ তা-বে বেশ কয়েকটি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিন রাজধানীর মালিবাগে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা ব্যক্তিরা একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, গত ২৮ অক্টোবর হাইকোর্টের সামনে আগুন দেওয়া আরেকটি বাসের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের পাঁচ যুবক বাসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। একই দিন কাকরাইলে একটি মোটরসাইকেলে করে দুই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি এসে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। চালকের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা পুলিশের পোশাক পরা ছিল।

চিঠিতে আরও বলা হয়, ২৮ অক্টোবরের সহিংসতায় পুলিশের সঙ্গে, অবৈধভাবে ও অসাংবিধানিকভাবে, অস্ত্রসহ যুক্ত হয়েছিল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু ছবির পাশাপাশি, পুলিশের ভেস্ট পরা এক আওয়ামী লীগ নেতা নিজের ছবি ফেসবুকে সগৌরবে আপলোড এবং পুলিশের সঙ্গে যৌথ আক্রমণে অংশগ্রহণের জানান দেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

৩১ অক্টোবর পুলিশের উপস্থিতিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের কাছে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। অনুরূপ আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়, বাংলামোটর মোড়ে পুলিশবক্সের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে ও মদদে আরেকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ৬ নভেম্বর ফেনীতে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে হাতেনাতে ধরা হয়। তিনি চট্টগ্রামের চিনি কারখানা থেকে আসা একটি ট্রাকে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করছিলেন।

চিঠিতে জানানো হয়, ১৪ নভেম্বর নাটোরে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে মশাল ও মুখোশসহ পুলিশ আটক করে। সেই সঙ্গে তার পরিত্যক্ত ঘর থেকে আরও ৬টি মশাল, ৩টি মুখোশ ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করে। আওয়ামী লীগের কর্মী জানার পর পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। ২১ নভেম্বর ভোলায় ছাত্রলীগের এক নেতার বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে একজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন একজন। ২৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী মারা যান। পুলিশ পরে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য সমস্ত প্রমাণ ধ্বংস করে ফেলে বলে বলা হয় চিঠিতে।

চলমান অগ্নিসংযোগের প্রতিটি ঘটনার একমাত্র বেনেফিশিয়ারি আওয়ামী লীগ ও তার অধীনস্থ রাষ্ট্রযন্ত্র। অন্যদিকে প্রধান ভুক্তভোগী বিএনপি। কোনো তদন্ত, তথ্য বা সূত্র ছাড়াই প্রতিটি ঘটনার পরপর অবলীলায় ও একই সুরে, অগ্নিসন্ত্রাসের দায় বিএনপির ওপর সরকার চাপিয়ে দিচ্ছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১৯ ডিসেম্বর চলন্ত ট্রেনে অগ্নিসংযোগ বিশ্লেষণে প্রতীয়মান- রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি চিহ্নিত অংশের যোগসাজশে এ নাশকতা সংঘটিত হয়েছে। এ ঘটনার দুদিন আগে ১৯ ডিসেম্বরের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বিশেষভাবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা, জরুরি পরিসেবা, ডাক্তার ও অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) নির্দেশনা দিয়েছিল। বিএনপি বিশ্বাস করে- এ নির্দেশনা কাকতালীয় কোনো বিষয় নয়। ডিএমপির প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়েছিল- জনমনে এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

বিএনপিকে দায়ী করে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামের বক্তব্য- এসব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থনে আওয়ামী লীগের যে চিরন্তন ‘ব্লেম গেম পলিটিক্স’, সেটিই আরও একবার জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে।

২০১৪-১৫ সালের ১০টি ঘটনা তুলে ধরা হয় চিঠিতে। উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ ঢাকায় তার নিজস্ব বাসলাইন বিহঙ্গ পরিবহনে পেট্রল দিয়ে আগুন দেওয়ার নির্দেশ দেন। একই বছর জানুয়ারির ১ তারিখ মাগুরায় একটি বাসে আগুন দেওয়ার সময় ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে আটক করা হয়। সে বছরেরই ৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই বছরের ১০ ডিসেম্বর সরকারি বিএল কলেজের ছাত্রলীগ বেশ কয়েকটি ছাত্রাবাসে আগুন ধরিয়ে দেয়।

২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুর মহিলা কলেজের সামনে আওয়ামী লীগের পেট্রলবোমা অগ্নিকাণ্ডে একটি অটোরিকশার দুই যাত্রী প্রাণ হারান। সে বছরেরই ১০ জানুয়ারি ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তিনটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে। সে সময় আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে জড়িত থাকার অভিযোগে হাতেনাতে ধরা হয়েছিল। যদিও পরে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছিল।

এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় পেট্রলবোমাসহ গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে পুলিশ যুবলীগের দুই কর্মীকে ছেড়ে দেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে ককটেল ও পেট্রলসহ আটক করা হয় বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়- আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের ১০টি উদাহরণ তুলে ধরা হয় চিঠিতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- গত ২৭ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আলী ইস্কান্দার তাকে ভোট না দিলে ভোটারদের হাত কেটে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার তার আসনে বিরোধী দলের কোনো কর্মীকে কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে দেখা গেলে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হবে বলে হুশিয়ারি দেন। কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সারোয়ার জাহান বাদশা ভোটারদের হুমকি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রমেশচন্দ্র সেন ভোটার ও বিএনপি সমর্থকদের হুমকি দিয়েছেন। গত ২৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ভোটারদের তাদের গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনগণ আজ একটি অর্থবহ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চায় যেখানে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। আসন্ন প্রহসনমূলক নির্বাচনের তথাকথিত প্রচারের সময় আওয়ামী লীগ নেতারা খোলাখুলি স্বীকার করছেন যে, তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোট কারচুপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পুনরায় একই নাটক মঞ্চস্থ করতে তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে, এটিই স্বাভাবিক।