প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

ইয়াবায় বাজিমাত টেকনাফের ‘ডি মারিয়ার’

১৯ জুলাই ২০২১ ১৮:০৯:৫৬ | আপডেট: ২ years আগে
ইয়াবায় বাজিমাত টেকনাফের ‘ডি মারিয়ার’
নুরুল আলম

হাসান আল জাভেদ

১০ বছর আগে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের শহর টেকনাফের বাসিন্দা নুরুল আলমের গল্পও ছিলো লাতিন আমেরিকার অনেক যুবকের মতো। যিনি নিম্ন আয়ের একটি পরিবারের সদস্য হয়েও ফুটবল পাগল ছিলেন এবং একজন তারকা ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। যেখানে তার পরিবারের জন্য তিনবেলা খাবার জোগাড় করাই ছিলো কষ্টসাধ্য। 

বাবা-মা’কে সাহায্য করার পর নিজের অবসরের জন্য যে অল্প সময়টুকু পেতেন তার প্রতেকটি মুহূর্ত তিনি ফুটবলের পেছনে ব্যয় করতেন। বাড়িতে পালিত মুরগি-ছাগল স্থানীয় নাজিরপাড়া বাজারে বিক্রি, রিকশা চালানো কিংবা বর্ষকালে নাফ নদী অথবা বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন উপকূলে ইলিশ মাছ ধরে বাবা-মাকে সাহায্য করতেন।

আর্জেন্টিনার একজন সমর্থক ও আর্জেন্টাইন তারকা অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার একজন বড় ভক্ত হিসেবে নুরুল তাকে অনুসরণ করতেন। যা বদলে দিয়েছিল নুরুলের পরিচয়। কক্সবাজার জেলার টেকনাফের সেই ছোট্ট গ্রামে কেউ নুরুলকে তার প্রকৃত নামে চেনে না। সেখানে তিনি ডি মারিয়া নামেই পরিচিত।

তবে নুরুল এখন আর ফুটবল খেলেন না। বদলে গেছে তার জীবনধারাও। এখন তিনি চোখ ধাঁধানো একটি দ্বিতল বাড়ির মালিক, চলাফেরা করেন বিলাসবহুল গাড়িতে, আছে টাকার বান্ডেল উপার্জনের মতো ব্যবসা এবং বিপুল পরিমাণ গোপন অর্থের বাইরেও ব্যাংকে জমা রয়েছে বড় অংকের টাকা।

দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে নুরুল জাদুকরী ও কষ্টিপাথরের মতো কিছু খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত পূরণ হয় তার মনের আশা। তার এই কষ্টিপাথরের নাম অ্যাম্ফিটামিন, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যা ইয়াবা নামে বেশি পরিচিত এবং কোথাও কোথাও মেথ নামেও পরিচিত।

মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা চোরাচালান করে আনতেন তিনি এবং সেগুলো খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে সরবরাহ করতেন।

১০ মিলিগ্রাম একটি ইয়াবা ঢাকায় প্রায় ৩০০ টাকায় খুচরা বিক্রি করতেন। যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুযায়ী, ২০০ গ্রামের বেশি ইয়াবা বহন, উৎপাদন, কেনাবেচা এবং সেবন করলে মৃত্যুদণ্ড অথবা আজীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স এক সময়ের রিকশা চালক নুরুলের ব্যাংক একাউন্টে ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকার সন্ধান পেয়েছে। তারা সোনালি ব্যাংকের টেকনাফ শাখায় ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩ টাকা, এবি ব্যাংকের ১ কোটি ৭১ লাখ, ৯৮ হাজার ৯৫৬ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকের একাউন্টে ৬ কোটি ১৮ লাখ ৬৮ হাজার ৬২০ টাকার সন্ধান পান। 

ইউনিটটি বলছে অবৈধ ইয়াবা বাণিজ্যের মাধ্যমে নুরুল এই টাকার মালিক হয়েছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নুরুলকে ইয়াবার বড় ব্যবসায়ী হিসেবে শনাক্ত করেছে। তার সহযোগী হিসেবে উঠে এসেছে ফরিদুল আলম, আক্তার কামাল, মোহাম্মদ তৈয়ব ও মোহাম্মদ হাসান এর নাম।

সিআইডি জানিয়েছে, নুরুলের সহযোগীরা খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে এবং এর একটা অংশ ব্যাংক একাউন্টে জমা করে।

সিআইডির এক তদন্ত কর্মকর্তা দ্য বিজনেস পোস্টকে  জানান, নুরুল আলম ও তার পরিবার পর্যটন শহর কক্সবাজারে একাধিক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করেছে।

সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, নুরুলের মতো বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা প্রথমে পণ্যসামগ্রী আমদানির নামে মোটা অংকের টাকা মিয়ানমারে পাচার করে এবং সেখানকার উৎপাদকদের থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে।

চোরাই পথে ইয়াবার চালান বাংলাদেশে আনার পর তারা এগুলো বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে এবং ব্যাংক একাউন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস অথবা ক্যাশের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। সংগ্রহকৃত টাকার একটা ছোট অংশ বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা হয়।

২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা চোরাচালান এবং সড়ক ও আকাশ পথে এগুলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে সরবরাহ করায় নুরুল আলমসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা দায়ের করেছে সিআইডি।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বাশার দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘টেকনাফের নাজির পাড়া গ্রামে ১০ বছর আগে দারিদ্রতার সঙ্গে নিত্য বাস ছিলো অধিকাংশ মানুষের। কিন্তু সেখানকার অনেক পরিবার ইয়াবা চোরাচালান করে হঠাৎ ধনী হয়ে উঠেছে এবং নুরুল আলম তাদের মধ্যে অন্যতম।’ 

তিনি আরও বলেন, 'স্থানীয় লোকজন তাকে ডি মারিয়া নামে চেনে। একসময় সে টেকনাফ বাজারে মুরগি ও ছাগল বিক্রি করতো এবং শহরে রিকশা চালাতো। আর এখন তার সম্পদের যে পরিমাণ তা কল্পনাতীত।’

নুরুল আলম দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। ২০১৮ সালে একটি মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি। পরবর্তীতে জামিনও পেয়ে যান সে মামলায়। এরপর মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আগে সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। এখন স্ত্রী ও ২ ছেলেকে নিয়ে টেকনাফের চকবাজারে বসবাস করেন তিনি।

এ বিষয়ে নুরুল আলমের ব্যক্তব্য জানতে দ্য বিজনেস পোস্ট  এর পক্ষ থেকে তার সাথে মুঠোফোনে এবং সরাসরি যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।

সিআইডির অর্থনৈতিক অপরাধ ইউনিটের বিশেষ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির দ্য বিজনেস পোস্টকে জানান, টেকনাফে মাদক ব্যবসা থেকে সৃষ্ট সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করছিলেন তারা।

তিনি বলেন, 'আমরা তাদের নামে অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজনের নামে থাকা ব্যাংক একাউন্ট এবং বিভিন্ন উৎস থেকে তাদের সম্পদের বিষয়ে পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করছি।'

সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যাংক একাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে জানিয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, 'তদন্ত শেষ করার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা আমাদের রিপোর্ট জমা দেবো। এরপর সরকার চাইলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।'

তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ধারণা, ব্যাংকের লেনদেন বা আমানতের বাইরেও মাদক ব্যবসায়ীররা দেশের বাইরে বড় অংকের অর্থ পাচার করেছে।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত টেকনাফের অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী থাইল্যান্ড, দুবাই ও সৌদি আরবের মতো বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর ১৩২ ইয়াবা চোরাকারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ও ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ২ ধাপে আত্মসমর্পণ করেন তারা।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আবুল ফয়সাল জানান, আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করেন তারা।

তিনি আরও জানান, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর যারা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের কেউ আবারও মাদকের ব্যবসার সাথে জড়িত হয়েছে প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

২০২০ সালে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭ পিস ইয়াবা জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর আগে ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮ পিস এবং ২০১৮ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৮ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।