প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

ভারতের সংকট সমাধানের উদ্যোগে বিপদে দেশীয় শিল্প

২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:৩৪:১১ | আপডেট: ২ years আগে
ভারতের সংকট সমাধানের উদ্যোগে বিপদে দেশীয় শিল্প

মিরাজ শামস

দেশীয় শিল্পকে বিপদে ফেলে ভারতে সয়াবিন মিল রপ্তানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন পোল্ট্রি খাতের উদ্যোক্তারা। তারা জানান, ভারতের সংকট মেটাতে রপ্তানির ফলে দেশে বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে পোল্ট্রি খাত।

পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিখাদ্য তৈরির অন্যতম উপাদান সয়াবিন মিল। এটি রপ্তানি বন্ধ চেয়ে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) উদ্যোগে পোল্ট্রি খাতের উদ্যোক্তারা সম্মিলিতভাবে দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।

বুধবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেছে ফিআব। সংগঠনটি জানায়, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় রপ্তানি বন্ধের পরামর্শ দিলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের পোল্ট্রি খাতের স্বার্থ উপেক্ষা করেই ভারতে সয়াবিন মিল রপ্তানির জন্য অব্যাহত ভাবে অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে।

ফিআবের সভাপতি এহতেশাম বি শাহজাহান বলেন, দেশে প্রায় ৩৫০টি ফিড মিলের মধ্যে ইতোমধ্যেই করোনা ধাক্কাসহ নানামুখী লোকসানের কারণে ৫০টি বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকতে শিগগিরই একটা বড় অংশ বন্ধের কবলে পড়বে। এছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

তার মতে, সয়াবিন মিল বিদেশে রপ্তানি করলে দেশের প্রায় অর্ধেক খামার ব্যবসায়ী ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবে। সেক্ষেত্রে খাতটি কিছু একচেটিয়া ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রনে চলে যাবে।

ফিআবের সাধারণ সম্পাদক আহসানুজ্জামান বলেন, বর্তমানে ভারতে সয়াবিন মিলের সংকট তৈরি হয়েছে। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে তাই দেশটির সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই উপকরণ আমদানির সুযোগ চায়। পরে বাংলাদেশ তাদের এই অনুমতি দেয়। যা গত মাসের শেষ থেকেই কার্যকর হয়। এরপর দেশের পোল্ট্রি খাতের স্বার্থে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণলায় রপ্তানি থেকে সরে আসার পরামর্শ দিলেও বাণিজ্য মন্ত্রণলায় তা অব্যাহত রেখেছে। একে তিনি নিজের ক্ষতি করে পরের উপকার করার সঙ্গে তুলনা করেন।

সংগঠনটির ট্রেজারার শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ইতোমধ্যেই দেশের বাজারে ডিম ও মুরগির দাম বাড়তে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই মাসের মধ্যে তা বেশিরভাগ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এছাড়া অনেক বিদেশি কোম্পানি এরইমধ্যে বড় বিনিয়োগ নিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। দেশীয় ফিড মিলগুলো কোনোভাবে বিপদে পড়লেই তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। তখন আর বাংলাদেশি কোম্পানি বাজারে থাকতে পারবে না। এই ব্যাপারগুলো আমলে নিয়ে দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এসময় ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশের সভাপতি ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার বলেন, ভারতে সয়াবিন মিলের রপ্তানি বন্ধ করা উচিত। পোল্ট্রি ফিডের এই মৌলিক কাঁচামাল আরও মূল্য সংযোজন করে ফিড উৎপাদন করে ভারতে রপ্তানি করতে পারত। সেই সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিখাদ্য তৈরিতে প্রধান কাঁচামাল ভূট্টা, সয়াবিন মিল, গম, আটা, ময়দা, ভাঙা চাউল, চালের কুড়া, ফিশ মিল, সরিষার খৈল, তৈল, ভিটামিন, মিনারেল অন্যতম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় ভূট্টা ও সয়াবিন মিল। ভূট্টার ব্যবহার প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ এবং সয়াবিন মিল প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেশে কয়েক বছর থেকে ভূট্টার আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশীয় চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ ভূট্টা দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। তবে সয়াবিনের উৎপাদন নিতান্তই নগণ্য।

দেশের ফিড মিলগুলোতে ব্যবহৃত কাঁচামালের অধিকাংশই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বর্তমানে চাহিদাকৃত ‘সয়াবিন মিল’ দেশীয় সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও ভারত, আমেরিকা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। দেশে সয়াবিন মিলের চাহিদা বছরে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ দেশীয় সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হতে নিয়ে ব্যবহার করে এবং অবশিষ্ট ২০ থেকে ২৫ ভাগ আমদানিতে চাহিদা মেটে।

এ অবস্থায় সয়াবিন মিলের রপ্তানি সিদ্ধান্তে খামারিরা উদ্বিগ্ন। কারণ ডিম, মাছ, মুরগি উৎপাদনে মোট খরচের প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই ব্যয় হয় খাদ্য বাবদ। তাই ফিডের মূল্য বৃদ্ধি পেলে খামারিদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অন্যদিকে খরচের বিপরীতে পণ্যের নায্য দাম না পাওয়ায় বড় অংকের লোকসানের মুখে পড়তে হবে।

দেশের মানুষের স্বার্থে শূণ্য শুল্ক সুবিধায় আনা সেই সয়াবিন সিড থেকে উৎপাদিত সয়াবিন মিলই এখন ৩ থেকে ৪টি সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার স্বার্থে রপ্তানি করছে। অতীতে কখনও ভারতে সয়াবিন সিড কিংবা সয়াবিন মিল রপ্তানি হয়নি। বরং ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর সয়াবিন মিল আমদানি করা হয়। এখন হঠাৎ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ায় দেশে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

এতে সয়াবিন মিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হলেও এলসি করা, অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতা, ল্যাব টেস্টের জটিলতা, বিলম্ব মাশুল, ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতার কারণে এখন সংকট মোকবেলা দূরহ হয়ে পড়বে।

২০২০ সালের আগস্টের তুলনায় গত আগস্টে কাঁচামালের দাম ৩৪.২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কাঁচামালের দাম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে খুব স্বাভাবিক নিয়মেই ফিডের দাম ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু খামারিদের কথা বিবেচনা করে ফিড প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো ফিডের দাম মাত্র ৬ থেকে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। এ অবস্থায় প্রোটিনের বড় যোগানদাতা এই খাতের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ না নিলে ডিম, দুধ, মাছ, মুরগি, গরু-ছাগলের মাংসের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্যখাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।