রাশেদ আহমদ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিকরা গৃহকর্মীর কাজসহ নানা কাজে যান। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপ বলছে, সেসব অভিবাসী নারী শ্রমিকই যখন বাড়ি ফিরে আসেন, তখন তাদের পড়তে হয় নানামুখি সামাজিক ও আর্থিক সংকটে।
জরিপে উঠে আসে, ২৫.২ শতাংশ নারী দেশে ফিরে আসার পর তাদের দাম্পত্য জীবনে নানা সংকট দেখা দেয়, ১৪.৭ শতাংশের বিবাহ বিচ্ছেদ এবং ১০.৫ শতাংশ নারীকে রেখে অন্যত্র চলে যান তাদের স্বামীরা।
এমন তথ্যই উঠে এসেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ‘প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসী নারীদের শ্রমিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন: সফলতা এবং ব্যর্থতা’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালনা করে শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি।
শুধু তাই নয়, জরিপে দেখা গেছে, এসব রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মধ্যে ১৭.৪ শতাংশ শারীরিকভাবে এবং ৭৮.৩ শতাংশ মানসিকভাবে তাদের প্রতিবেশী, পরিবার এবং বন্ধুদের দ্বারা নির্যাতনে শিকার হয়।
দেশে ফেরা নারী প্রবাসীদের প্রতি ৩ জনের মধ্যে একজন অভিযোগ করেন, তারা বাড়ি ফিরে আসার পর তাদেরকে চরিত্রহীন বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বেগম মাকসুরা নূর দ্য বিজনেস পোস্ট'কে বলেন, তারা নারী প্রবাসীদের সামাজিক পুনর্গঠন নিয়ে সচেতন, কিন্তু এ বিষয়ে তাদের কোনো কর্মসূচি নেই।
তিনি আরও বলেন, পুরুষ ও নারী উভয় অভিবাসীর জন্যই তাদের আর্থিক পুনর্গঠন কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু নারী অভিবাসীদের জন্য আলাদা কোনো সামাজিক পুনর্গঠন কর্মসূচি নেই।
২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে ১২টি উপজেলায় ৩২৩ জন দেশে ফেরা নারী অভিবাসীর ওপর জরিপ চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, ৬১ শতাংশই নারীই আর্থিক সংকটে রয়েছেন।
বিআইএলএস-এর উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ফিরে আসা শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ বেকার জীবন যাপন করছেন। তাদের মধ্যে ২৭ শতাংশ চাকরির জন্য আবারও বিদেশে যেতে ইচ্ছুক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বোচ্চ ১০ বছর বিদেশে কাজ করেছেন এবং গত ১০ বছরের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন এমন নারীদের নিয়েই এ জরিপ চালানো হয়।
পরিবারের খরচ জোগার করতে ৮.৭ শতাংশ নারী দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন, ৫.৬ শতাংশ ছোট ব্যবসা এবং ৯ শতাংশ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন বলে জরিপে ওঠে আসে।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, নারী অভিবাসীদের সামাজিক ও আর্থিকভাবে পুনর্গঠন বাংলাদেশে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে যে, বিদেশে যেসব নারীরা কাজের জন্য যান, তারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকেন।
তারা বলছেন, এ ধারণা সমাজে গড়ে উঠেছে এ কারণে যে, প্রবাসে যাওয়া নারীদের একটি অংশই দেখা যায়,
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই শরীরে বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
বিআইএলএসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফিরে আসা ৬১ জনকে শ্রমিক হিসেবে জোরপূর্বক বিদেশে পাঠানো হয়েছিলো।
গত এপ্রিলে একটি বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্পে ২৬২ জন নারী প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসীদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
যেখানে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৬০ শতাংশ শারীরিকভাবে নির্যাতিত, ৫০ শতাংশ জোরপূর্বক কাজ করানোর শিকার, ৩৭ শতাংশ নিয়োগকর্তার আত্মীয়দের বাড়িতে বিনা বেতনে কাজ করেছেন, ৩৩ শতাংশ মানসিকভাবে নির্যাতিত এবং ১৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
ব্র্যাকের অভিবাসী প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, যখন এ ধরনের খবর জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তখন সামাজিকভাবে এ সমস্যা তৈরি হয়।
তিনি আরও বলেন, নারী শ্রমিকরা যখন বাড়িতে ফিরে আসে তখন তাদের গ্রহণ করতে আগ্রহী হন না অনেকেই।
বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা অধিকার সংস্থা বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলোতে অপব্যবহারের ঘটনা তিনগুণ বেড়েছে।
কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে উপসাগরীয় রাজ্যের ৪৭ হাজার ৯৯১ জন অভিবাসী শ্রমিককে অপব্যবহারের শিকার হতে হয়েছিল। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ এর মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনের এ সংখ্যাকে বিস্তর এ অভিযোগের মধ্যে মাত্র একটি চিত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১০ সালের মার্চ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ এর মধ্যে তৈরি করা এ প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ শুরু হলে উপসাগরীয় রাজ্যের ৪৭ হাজার ৯৯১ জন অভিবাসী শ্রমিক অপব্যবহারের শিকার হতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র বিএনএসকে-এর নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, দেশে নারী শ্রমিকদের পুনর্গঠনের সমস্যার সমাধান করা হয়নি। তিনি সরকারকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।
মানবাধিকার কর্মীরা বিদেশে শ্রমিকদের অপব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ারও দাবি জানান।
বিশ্বে শীর্ষ শ্রমিক পাঠানোর দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিএমইটি পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৯১ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯৯ জন নারীসহ বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ১৩.২ মিলিয়ন।
যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। নারী অভিবাসীদের মধ্যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ৮টি দেশেই পাঠানো হয়েছে ৯৯ শতাংশ, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৯.৫৯ শতাংশ রয়েছেন সৌদি আরবে।