প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কুপন-ক্যাশ ব্যাক অফার

১৮ অক্টোবর ২০২১ ১২:২৪:১৬ | আপডেট: ২ years আগে
আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কুপন-ক্যাশ ব্যাক অফার

মেহেদী আল আমিন

কুপন, টিকিট আর পুরস্কার দেয়ার অফার করে কোম্পানির বিক্রি বাড়ানো দেশীয় আইনে অপরাধ হলেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই দিনের পর দিন তা করে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় কোম্পানি।

বিদ্যমান আইন, বিশেষ করে দণ্ডবিধি এবং প্রতিযোগিতা আইনের ২৯৪বি ধারা অনুযায়ী পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে ভোক্তাদের এসব অফার ও পুরস্কার দেয়া বেআইনী।

দ্য বিজনেস পোস্ট’কে আইনজীবীরা বলেন, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, রাইড-শেয়ারিং এবং ফুড ডেলিভারি কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সুপার শপ- এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিতই ভোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য ডিসকাউন্ট কুপন, প্রোমো কোড এবং পুরস্কারের অফার দিচ্ছে, যা আইনের লঙ্ঘন।

উদাহরণস্বরূপ, জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং এবং ফুড ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম পাঠাও অ্যাপ একটি বিজ্ঞাপন দেখায়। যেখানে বলা হয়, পাঠাও ফুডে ৫৫ টাকা ছাড়। প্রোমো DINNER55 এপ্লাই করুন। এখনই অর্ডার করুন এবং দ্রুত ডেলিভারি নিন।

আর শীর্ষস্থানীয় টেলিকম কোম্পানি বাংলালিংকের একটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, MyBL অ্যাপ রেফারেন্সে 500MB ফ্রি। 500MB-4দিন, MyBL অ্যাপের রেফারেল নম্বর আপনার স্বজনদের সাথে শেয়ার করুন। এ কোড ব্যবহার করে প্রথম লগইনে 1GB-4 দিন ব্যবহার করা যাবে।

২৯৪বি ধারা অনুসারে, যে কেউ যে কোন বাণিজ্য, ব্যবসা বা কোন পণ্য বিক্রয়, কোন পুরস্কার, পুরষ্কার বা অন্যান্য অনুরূপ বিবেচনায় যে কোন নামেই হোক না কেন, অর্থ বা প্রকারের মধ্যে, যে কোনটির বিরুদ্ধে কুপন, টিকিট, সংখ্যা বা চিত্র, অথবা অন্য কোন যন্ত্র দ্বারা, ব্যবসা বা ব্যবসা বা কোন পণ্য কেনার জন্য, অথবা বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বা কোন পণ্যকে জনপ্রিয় করার জন্য প্ররোচনা বা উৎসাহ হিসেবে এবং যে কেউ এ ধরনের অফার দেয় কিংবা বর্ণনা করে, তাদের ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে হতে পারে, অথবা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে।

‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা’

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ আহসানুল করিম বলেন, ভোক্তা জালিয়াতি রোধ এবং তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে দেশে পেনাল কোড ১৮৬০ এর ধারা ২৯৪বি এবং প্রতিযোগিতা আইন ২০১২ উভয়ই প্রণীত হয়েছিল।

শুধু ভোক্তা নয়, অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও একই পথে পা বাড়িয়েছে বেশ কয়েকটি বড় কর্পোরেশনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার দখল করেছে এবং তারা তাদের প্রতিযোগীদের জন্য শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

নিজেদের বিজ্ঞাপন নীতি সম্পর্কে বাংলালিংকের কর্পোরেট কমিউনিকেশনের প্রধান অংকিত সুরেকা বলেন, প্রস্তাবিত অফারগুলো প্রচারমূলক প্রকৃতির এবং আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে তা প্রচার করছি।

তিনি বলেন, সকল মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমএনও) নিয়মিতভাবেই এ ধরনের প্রচারমূলক প্রচারণা চালায়, যাতে মানুষকে ডিজিটাল জীবনধারা গ্রহণে উৎসাহিত করা যায়, যা দেশের আইন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রচারমূলক অফার দিচ্ছে বাংলালিংক।

অন্যান্য এমএনও একই ধরনের প্রমোশন চালাচ্ছে। কিন্তু আইনজীবীরা বলছেন, এ ধরনের অফার সংশ্লিষ্ট আইন লঙ্ঘন করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, কোড, নম্বর বা যা-ই বলা হোক না কেন, এ ধরনের অফার বা ক্যাশ ব্যাক প্রোগ্রাম দণ্ডবিধিতে অবৈধ। এ ধরনের আচরণ দণ্ডবিধির ২৯৪বি ধারার অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

তিনি বলেন, স্টক শেষ করার জন্য গ্রাহকদের ছাড় দেয়া বিশ্বজুড়ে একটি বৈধ চর্চা। কিন্তু ছাড়কৃত মূল্য একটি নির্দিষ্ট পণ্যের উৎপাদন খরচের চেয়ে কম হতে পারে না। আমাদের আইন বৈশ্বিক হিসেব অনুযায়ী সংশোধন করা দরকার।

এটাও লক্ষ করা উচিত, বেশিরভাগ ই-কমার্স কোম্পানির খুব কম দামে পণ্য সরবরাহ করার চর্চা রয়েছে এবং কখনও কখনও তারা একটি পণ্যের দামে দুটি পণ্যও অফার করে।

তিনি আরও বলেন, অসঙ্গতিপূর্ণভাবে দাম কমানো বা বাড়ানোকে অনুমোদন দেয়না প্রতিযোগিতা আইন। এটি কোম্পানিগুলোকে তাদের গ্রাহকদের পণ্য এবং পরিষেবা গ্রহণের মাধ্যম হিসাবে কোনও নির্দিষ্ট এজেন্ট বা সংস্থার উপর নির্ভরশীল করা অবৈধ করে তোলে।

উদাহরণস্বরূপ, যখন কোন সুপার শপ বা অন্য কোন কোম্পানি- কোন বিশেষ মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী, অথবা কোন বিশেষ ব্যাংকের ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিল পরিশোধে ক্যাশ ব্যাকের অফার দেয়, তখন তা দণ্ডবিধি এবং প্রতিযোগিতা আইন- দুটোতেই অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দেশের আরেকটি শীর্ষস্থানীয় খাদ্য এবং মুদি মালামাল সরবরাহ পরিষেবা প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডা। প্রতিষ্ঠানটির একটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২৫০ টাকা পর্যন্ত ক্যাশ ব্যাক। লংকাবাংলা ক্রেডিট কার্ড হোল্ডাররা ফুডপান্ডার ৮০০ টাকার ওপরের সব অর্ডারে ১০ শতাংশ ছাড় পেতে পারেন! অফারটি ২০ অক্টোবর, ২০২১ পর্যন্ত প্রযোজ্য।

প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত, এ বিষয়ে ইমেলের মাধ্যমে প্রতিবেদককের জানতে চাওয়া প্রশ্নের উত্তর দেয়নি ফুডপান্ডা।

অনেক কোম্পানি এখন এ ধরনের কাজ করছে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো নিয়মিত এমন অফার করছে, যা গ্রাহকদের একটি নির্দিষ্ট মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারীর ওপর নির্ভর করতে উৎসাহিত করছে।

প্রতিযোগিতা আইন কি বলে?

আইনের ধারা ১৫ (১) অনুসারে, কোন ব্যক্তি উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, সংরক্ষণ বা অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কোন চুক্তি বা সংঘবদ্ধতা, প্রকাশ বা অন্তর্নিহিত হবে না, যা প্রতিযোগিতায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বা হতে পারে অথবা বাজারে একচেটিয়া ভাব তৈরি করে।

এদিকে, একই আইনের ধারা ১৫ (৩) বলছে, নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে এবং চুক্তিগুলো প্রতিযোগিতামূলক বিরোধী চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে যদি তারা প্রতিযোগিতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে।

যদি প্রতিযোগিতা কমিশন কর্তৃক আদালতে মামলা করা হয়, তাহলে আইন লঙ্ঘনে জড়িত যে কেউ জরিমানা বা কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, যদি কোন প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতি গ্রহণ করে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবো। অপরাধী প্রতিষ্ঠান জরিমানার আওতায় আসবে। জরিমানা পরিশোধ না করলে আমরা পরবর্তী একটি মামলা দায়ের করব।

তিনি বলেন, উদাহরণ স্বরূপ, আমরা প্রায় এক বছর আগে ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা করেছি এবং ৮ মাস আগে আদালত এ মামলায় একটি আদেশ দিয়েছেন।

এ কর্মকর্তা বলেন, যখন একজন ভোক্তাকে অন্য পণ্য পাওয়ার জন্য একটি পণ্য কিনতে হয়, এমন শর্তসাপেক্ষ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে কমিশন । একটি কোম্পানি তাদের ব্যবসার প্রচারের জন্য অফার দিতেই পারে, কিন্তু যদি এটি উৎপাদন খরচের চেয়েও কম হয়, তাহলে আইন হস্তক্ষেপ করবে।

আইনের এ ধারাগুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজির হোসেন বলেন, নতুন আইন প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও, দণ্ডবিধি বা প্রতিযোগিতা আইনের ২৯৪বি ধারার অধীনে দায়ের করা একটি মামলা রয়েছে, যা প্রায় অস্তিত্বহীন।

কারও ব্যবসা বা রাজনৈতিক পরিচয়কে গুরুত্ব না দিয়ে সবার জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ করা দরকার। পণ্য বা পরিষেবার মূল্য পরিশোধে ছাড় দেয়ার জন্য সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণে আইন সংশোধন করা যেতে পারে বলেও মনে করেন ক্যাবের সহ-সভাপতি।