প্রচ্ছদ ›› শিক্ষা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
২০ অক্টোবর ২০২১ ০৯:৫৪:০২ | আপডেট: ২ years আগে
পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়

ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ১৬৩ বছর আগের পাঠশালাটি আজ পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর সাড়ে ৭ একর জায়গা নিয়ে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মধ্যদিয়ে জগন্নাথ কলেজটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। আজ জবি’র ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নতুন হলেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে সুদীর্ঘ গৌরবোজ্জল ইতিহাস। বাংলদেশের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুথান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামেই জগন্নাথের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। 

২০ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হলেও, এ বার বিশেষ করাণে তা উদযাপিত হবে ২১ অক্টোবর। ২০ অক্টোবর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও লক্ষ্মীপূজা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচি এক দিন পেছানো হয়েছে। গত বছরের মতো এবছরও স্বল্প পরিসরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হবে।

কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২১ অক্টোবর বেলা ১১টায় জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনা, বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের উদ্বোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ ইমদাদুল হক। এরপর বেলা ১২টায় অনলাইনে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক মেডেকেল সেন্টারে টিকা কেন্দ্র উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।

দেড় শতাধিক বছর আগে তৎকালীন ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা দীননাথ সেন, অনাথ বন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায়, ব্রজসুন্দর মিত্র প্রমুখের প্রচেষ্টায় ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্ম স্কুল যাত্রা শুরু করে। ব্রাহ্ম স্কুল প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই স্কুলটি ভয়াবহ রকমের আর্থিক সংকটে পড়ে। ফলে স্কুলটি টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে। কিশোরীলাল চৌধুরী তার পিতার নামে স্কুলের নামকরণ করেন ‘জগন্নাথ স্কুল’। এভাবেই ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জন্মলাভ করে জগন্নাথ স্কুল।

স্কুলের অবস্থা ভালো হওয়ায় ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ স্কুলকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে রূপান্তর করা হয়। মাত্র ৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে জগন্নাথ কলেজ যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কলেজ দ্রুত উন্নতি লাভ করায় মাত্র পাঁচ বছরে অর্থাৎ ১৮৮৯ সালে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯৬জন এবং ১৯১০ সালের পূর্বেই জগন্নাথ কলেজের ছাত্র সংখ্যা ৫০০ জনে পৌঁছে। ক্রমান্বয়ে ১৯০৮ সালে জগন্নাথ কলেজ প্রথম শ্রেণির কলেজ রূপান্তরিত হয়।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে এটিকে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক ও জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়।

শুধু তাই নয়, পুরান ঢাকার নারী শিক্ষায় বাঁধা দূর করতে ১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার এই কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় সহশিক্ষা চালু করেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণ করা হলেও পরের বছরে আবার এটি বেসরকারি মর্যাদায় ফিরে যায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একাট্টা হয়ে জগন্নাথের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বরাবরের মতোই ছিল উল্লেখ করার মতো।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম যে ১০ জন ১৪৪ ধারা ভেঙে ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের বীজ মূলত জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই বপন করা হয়। এছাড়াও ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষিত হলে তার সমর্থনে সফল হরতাল পালনে ভূমিকা পালন করে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কাজী আরেফ আহমেদ ও চিত্রনায়ক ফারুক।

ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন- শিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী, আখতারুজ্জামন ইলিয়াস, ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হাসান, সাংবাদিক রাহাত খান, আ ন ম বজলুর রহমান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, ড. শামসুজ্জামান খান, হায়াৎ মাহমুদ, বিক্রমপুরের ইতিহাস খ্যাত লেখক শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গবেষক গোলাম মুরশিদ ও মির্জা হারুণ-অর রশিদ, বাংলাদশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ, কথা শিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, ইংলিশ চ্যানেল পাঁড়ি দেয়া সাঁতারু ব্রজেনদাস, বাঙালি কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, লেখক ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমাদাদুল হক মিলন, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র সাইদ খোকন, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ.আর.ইউসুফ, গায়ক ফকির আলমগীর, কিরণ চন্দ্র রায়, হায়দার হোসেন ও বিপ্লব, অভিনেতা এ.টি.এম.শামসুজ্জামান, জাহিদ হাসান, মীর সাব্বির, ফারুক ও প্রবীর মিত্র, জাদুকর জুয়েল আইচসহ অনেকে।

নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর সাড়ে ৭ একর জায়গা নিয়ে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদে ৩৬টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউটে প্রায় ৬৭৯ জন শিক্ষক, ১৩ হাজার ১৬৫ জন শিক্ষার্থী, ৬৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সাতটি শিক্ষাবর্ষে ২১৪ জন শিক্ষার্থী এমফিল ও ৮৭ জন পিএইচডি করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বাংলাবাজারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রীহল ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের’ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ছাত্রী উঠানোর জন্য আবেদন নেয়া হয়েছে। শীঘ্রই ছাত্রীরা হলে উঠবেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা সংকুলান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা, নতুন একাডেমিক ভবন এবং গবেষণা কাজের সুবিধার্থে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় ২০০ একর জমিতে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

মাত্র ১৬ বছরের পথচলায় বিশ্বিবদ্যালয়টির প্রাপ্তিও কম নয় । বিসিএস, সরকারি ও কর্পোরেট চাকরি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টির লাইব্রেরি, ইন্টারনেট সুবিধা এবং গবেষণাগারেও নজর বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে সমগ্র ক্যাম্পাস ইন্টারনেটের আওতায় আনা হয়েছে। ই-বুক সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখন সকল বই ও গবেষণা পত্রিকা পড়ার জন্য শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই সব অনলাইনে প্রবেশ করতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ ইমদাদুল হক বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিতে আমি কাজ করছি। আমরা গবেষণা খাতে গতবারের চেয়ে বাজেট ডাবল করে দিয়েছি। সাথে সাথে লাইব্রেরী, আইসিটি, কম্পিউটার কেনা এসকল ক্ষেত্রে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। আমি উপাচার্য হয়ে আসার সাথে সাথে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা শিল্প পরিষদ (বিসিএসআইআর) এর সাথে চুক্তি করেছি যাতে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সহজে গবেষণা করতে পারে। আমরা শীঘ্রই পরমাণু শক্তি কমিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের সাথে চুক্তি করবো।

উপাচার্য আরও বলেন, আমরা করোনাকালীন পরিস্থিতিতে প্রায় অর্ধকোটি টাকা শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। শিক্ষার্থীদের করোনা টিকা দেয়ার জন্য টিকা কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাবস্থা করেছি এবং এই কোভিডের সময়েও গত ঈদে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব পরিবহনে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হয় এবং এটা একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়, সেই প্রত্যাশা রেখে কাজ করে যাবো।