প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

স্বাধীনতার ৫০ বছর

বিদ্যুতে সমৃদ্ধি: ৫৪২ থেকে ২৫ হাজার মেগাওয়াট

০২ ডিসেম্বর ২০২১ ১৭:০৯:০৯ | আপডেট: ২ years আগে
বিদ্যুতে সমৃদ্ধি: ৫৪২ থেকে ২৫ হাজার মেগাওয়াট

হাসান আরিফ

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সাফল্য যে কতটা, বিদ্যুৎ খাতের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, তা অনেকাংশেই বলে দেয়। কারণ, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা স্বাধীনতার সময় ৫৪২ মেগাওয়াট থাকলেও তা বেড়ে এখন প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে।

প্রাথমিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরো ক্ষমতাই সরকারি খাতে সীমাবদ্ধ ছিল, যা এখন বেসরকারি খাতের রয়েছে ৫১ শতাংশ।

১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে ২৪ হাজার ৫৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে। ফলে ক্যাপটিভসহ বিদ্যুতের স্থাপিত সক্ষমতা ২৪ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াটে পৌঁছায়।

এছাড়াও, এখন গোটা দেশে মোট জনসংখ্যার ৯৯.৭৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়, তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো: হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, সঞ্চালন লাইনে কিছু সমস্যার কারণে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এখনও সম্ভব নয়, তবে ২০২৩ সালের মধ্যে আমরা তা অতিক্রম করতে পারবো বলে আশাবাদী।

তিনি বলেন, আমরা এখন ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের উন্নয়ন করছি।

হাবিবুর রহমান বলেন, এটি সঠিকভাবে করা গেলে বিভ্রাট ছাড়াই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। কিন্তু এর পরও আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে, কারণ অগ্রগতির শেষ নেই।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, ১৪ হাজার ১১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে এবং নির্বিঘ্নে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে ২ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২০টি প্ল্যান্টের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের কাজ চলছে।

এছাড়া ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দেশে প্রায় ৪০টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি রয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ চলতি বছরের জুনে এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ শতাংশ নিষ্ক্রিয় রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে।

গবেষণা সংস্থাটি মে মাসে মাত্র এক দিনের হিসাবের ভিত্তিতে এ চিত্র পায়।

সরকার তেল ও গ্যাসভিত্তিক ভাড়া এবং কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট অনুমোদন করেছে, কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী সরকার তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ না কিনলে ক্যাপাসিটি চার্জ নামে একটি নির্দিষ্ট চার্জ দিতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতি বছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা দেয়।

ইউএস-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ৪৩ শতাংশ কাজ করছে এবং বাকি ৫৭ শতাংশ অলস রয়ে গেছে, যদিও তাদের ভাড়া দিতে হবে।

বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ

গত এক দশকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের ব্যাপক নির্মাণের ফলে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৬৯২ সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইন ৬.০৩ লাখ কিলোমিটার।

সামগ্রিক সিস্টেম লস এক দশকে প্রায় ৫ শতাংশ কমে অর্থবছর ২০০৯ এর ১৬.৮৫ শতাংশ থেকে অর্থবছর ২০২০ এ নেমে এসেছে ১১.২৩ শতাংশে।

২০৩০ সালের মধ্যে, সরকার সব উপজেলাকে শতভাগ বিদ্যুৎতায়নের আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে ট্রান্সমিশন লাইনের দৈর্ঘ্য ২৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইনের দৈর্ঘ্য ৬.৬ লাখ কিলোমিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে।

স্বাধীনতা থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন

স্বাধীনতার পর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে গ্রিডে ছিল মাত্র ৫৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে, এক বছরে ৫৫ মেগাওয়াট যুক্ত হয়েছিল, এতে সক্ষমতা পৌঁছে ৬০২ মেগাওয়াটে। এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করে।

এরপর ১৯৮০-৮১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে ৮১৩ মেগাওয়াটে এবং ১৯৮৩-৮৪ সালে আরও বেড়ে ১ হাজার ১২১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করে ১ হাজার ১৪৬ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে।

১৯৯০-৯১ সালে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৩৬৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছায়। ১৯৯৭-৯৮ সালে এটি ছিল ৩ হাজার ৯১ মেগাওয়াট, ২০০০-২০০১ সালে ৪ হাজার ৫ মেগাওয়াট, যেখানে ২০০৫-০৬ সালে ৫ হাজার ২৪৫ মেগাওয়াট, ২০১০-১১ সালে ৭ হাজার ২৬৪ মেগাওয়াট, ২০১৩-১৪ সালে ১০ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট, ২০১৭-১৮ সালে ১৫ হাজার ৯৫৩ মেগাওয়াট এবং ২০২০-২১ সালে ২২ হাজার ৩১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিদ্যুৎ খাতে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে কম সময়ে তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন।

এর আগে শুধুমাত্র কাপ্তাই হাইড্রোপাওয়ার প্ল্যান্টই একটি বড় ছিল। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গ্রিডের জন্য ২২ হাজার মেগাওয়াট উৎপন্ন হয় এবং আনুমানিক চাহিদা ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট।

তিনি বলেন, বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও মানুষ লোডশেডিংয়ের অভিযোগ করে। সে কারণেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নতুন সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন, সাবস্টেশন এবং ভূগর্ভস্থ ডিস্ট্রিবিউশন নির্মাণ করা হচ্ছে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় অনেককে আকর্ষণ করে এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা চুক্তিতে জয়ী হলেও সঞ্চালন ও বিতরণে কোনো আগ্রহ নেই।

তিনি রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে সরকারি খাতে দুর্নীতির লাইসেন্স হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, এগুলো বাংলাদেশের জন্য কখনোই প্রয়োজন ছিল না।

রহমতুল্লাহ ব্যাখ্যা করেন, বিদ্যুতের জন্য ৪০ শতাংশ উৎপাদনে, ৪০ শতাংশ সঞ্চালনে এবং ২০ শতাংশ বিতরণে ব্যয় করা হয়। তবুও, কেউই ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন পরিচালনা করতে আগ্রহী নয়।

তিনি বলেন, আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট, এমনটা বলা হলেও আসলে বাস্তবতা ভিন্ন। যদি একটি প্ল্যান্ট ১০০ মেগাওয়াট উৎপন্ন করে এমনটা বলা হয়, তাহলে সেটির প্রকৃত আউটপুট ২০ মেগাওয়াট হতে পারে।

বিদ্যুৎ আমদানি

আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্মসূচির আওতায় ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াট আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

এছাড়া ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

স্বাধীনতার আগে বিদ্যুৎ খাত

১৯৪৮ সালে সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা এবং উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এক বছর পর বিদ্যুৎ বিভাগ এর সাথে একীভূত হয়। সে সময় সিদ্ধিরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় অপেক্ষাকৃত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, সিদ্ধিরগঞ্জে একটি ১০ মেগাওয়াট স্টিম টারবাইন পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছিল যখন কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৪০ মেগাওয়াটের একটি প্ল্যান্ট কাপ্তাইতে ছিল, যা সেই সময়ে একটি বড় প্ল্যান্ট হিসাবে বিবেচিত হতো।

১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন চালু করা হয়। যা দেশের বিদ্যুতের উন্নয়নে একটি মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের ইতিহাস

১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলের জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ পাওয়ার যাত্রা শুরু হয়।

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৩০ সালে। পরে বাণিজ্যিকভাবে বিতরণের জন্য ধানমন্ডি পাওয়ার হাউস স্থাপন করা হয়।

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় এ অঞ্চলে একটি ব্যক্তিগত বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তীতে ১৭টি প্রাদেশিক জেলার শহরাঞ্চলে সীমিত বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়।

সে সময় অধিকাংশ জেলায় রাতে সীমিত সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। ১ হাজার ৫০০ কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার দুটি জেনারেটর দিয়ে এটি ঢাকায় সরবরাহ করা হয়েছিল।