সজীব সরকার
ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুদের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও বাস্তবে এই প্রবণতা বাড়ছে। পথে-ঘাটে বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের মাধ্যমে ভিক্ষা করান। খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, ওই শিশুদের বাবা-মায়েরা আশে-পাশেই রয়েছেন এবং শিশুদের রোজগারের ওপর নজর রাখছেন। অনেক সময় অভিভাবকরা শিশুদের ধমক দিয়ে এমনকি চড়-থাপ্পড় মেরে কারো কাছে টাকা চাওয়ার জন্যে জোর করে পাঠাচ্ছেন। এমন চিত্রের সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে উপার্জনের উপায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ নতুন করে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়েছেন। এই সময়টিতে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুদের ব্যবহার অনেক বেশি বেড়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দারিদ্র্য বেড়েছে, না খেয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের দুর্দশার এসব চিত্র ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সহায়তার প্রবণতা মানুষের মধ্যে বেড়েছে। এই সুযোগে মানুষের আবেগকে পুঁজি করে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
বর্তমান দুর্যোগ মোকাবিলায় নানা ধরনের সমাধান খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতির কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু জীবনের শুরুতেই কোমলমতি শিশুরা যে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে যাচ্ছে, এর ভবিষ্যত প্রভাব নিয়েও ভাবা জরুরি। দু-চার বছর বয়স থেকেই যে শিশুটি ভিক্ষা চাইতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে সে কর্মোদ্যোগী হবে-এমনটি আশা করা ভুল। দেখা যাবে, একটু বড় হয়ে যখন ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবনধারণের পর্যাপ্ত রসদ যোগাড় হচ্ছে না, তখন তার পক্ষে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টার চেয়ে বরং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। শিশু-কিশোর অপরাধীদের কেস স্টাডিগুলো পর্যালোচনা করলেই এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে।
তাই অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের এবং পথশিশুদের ব্যাপারে জরিপ, গবেষণা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার দরকার রয়েছে। স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুরা কোথায় যাচ্ছে, কী ঘটছে তাদের জীবনে- এর খোঁজ রাখা দরকার। আমি বিভিন্ন সময় পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বা লেখালেখি করতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, যেসব সংগঠন শিশুদের নিয়ে কাজ করে, তাদের কাছে পথশিশুদের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। তাহলে প্রশ্ন থাকে : এসব সংগঠন শিশুদের নিয়ে কী কাজ করছে? এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনা দরকার, সরকারি নজরদারিতে রাখা দরকার। এর পাশাপাশি শিশুদের সুরক্ষায় প্রণীত আইন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারের শর্তগুলোরও বাস্তবায়ন ঘটানো দরকার।
দারিদ্র্যের কষাঘাতে কদর্য, পঙ্কিল বা নির্মম নয়, শিশুদের জীবন হোক নিশ্চিন্ত, নির্ভার ও প্রাণোচ্ছ্বল; শিশুদের মধ্যে রয়েছে যে অফুরান সম্ভাবনা, তা বিকশিত হোক পুষ্প-পল্লবে। এতেই জাতির মঙ্গল নিহিত।
* লেখক : সজীব সরকার : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা : মিডিয়াস্কুল ডট এক্সওয়াইডেজ।