প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

করোনার সঙ্গে বসবাস: হাসপাতালে যেমন আছি, যা দেখলাম

০৩ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৫৯:০০ | আপডেট: ৩ years আগে
করোনার সঙ্গে বসবাস: হাসপাতালে যেমন আছি, যা দেখলাম

গত ২১ জুন রাতে আব্বা আকরাম হোসেন মুক্তার জ্বর, সর্দি ও কাশি দেখা দেয়। সঙ্গে সারা গায়ে ব্যথা। এরপর একে একে আমি, আমার স্ত্রীও জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হই। বুঝতে পারি, আমরা সবাই হয়তো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। পরীক্ষার জন্য পরিবারের সবার নমুনা দেই গফরগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ফলাফল আসে ৩ দিন পর। আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের সবার ফলাফল ‘নেগেটিভ’। তার মানে আমাদের কারও করোনা হয়নি! অথচ পরিবারে সব সদস্যদের মাঝেই করোনার প্রায় সব উপসর্গ বিদ্যমান।

এসব উপসর্গ নিয়েই আমরা ৮ দিন বাসায় অবস্থান করছিলাম। পাশাপাশি পারিবারিক আর পরিচিত চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসাও চলছিল। এর মাঝে ২৮ জুন রাতে হঠাৎ আমার স্ত্রী মীমের (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী) শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায়। প্রচণ্ড কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আল্লাহর রহমতে তাকে ঐ রাতে এবং পরের দিন সকালে নেব্যুলাইজ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

২৯ জুন সন্ধ্যায় মীম যখন গফরগাঁও থেকে তার ভাইয়ের সাথে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হয়, সময়টা ছিল ভীষণ বেদনাদায়ক। মীম ভর্তি হওয়ার পর আমার বাবার শরীর অবনতির দিকে যেতে থাকে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনিও হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানোর কথা বলেন। অস্থির হয়ে ওঠেন। পরিবারের ডা. বড় ভাই এর পরামর্শে রাতেই এম্বুল্যান্সে করে আমি আর বাবা রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।



রাত দেড়টায় আমি অ্যাম্বুলেন্সে করে বাবাকে নিয়ে রওনা হই। পুরো রাস্তায় উৎকন্ঠা নিয়ে ঢাকার দিকে যেতে থাকলাম। যেতে যেতে ভাবলাম, মীমকে একা পাঠানোর পর আমার কেমন শূন্য-শূন্য লেগেছিল। এখন আমি আর আমার বাবাকে এভাবে পাঠানোর পর আমার আম্মা কীভাবে এই কষ্ট সইছে? এসব ভাবতে ভাবতেই কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পৌছে যাই আমরা। তখন বাজে ভোর চারটা।

পৌছানোর সাথে সাথেই বাবার অবস্থা দেখে তারা ভর্তি নিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেবের আন্তরিক ভূমিকা অনিস্বীকার্য। তার সরাসরি সহযোগিতায় আমার স্ত্রী, বাবা এবং আমাকে একই রুমে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়।

এখানে ভর্তির প্রক্রিয়াটা খুব জটিল মনে হয়নি। দূর থেকে একজন নাম, ঠিকানা, বয়স জেনে নোট নিলো। সমস্যাগুলো জানলো। রোগীর অবস্থা দেখে বসতে বলল। একটু পর এই ভোর ৪টা ১৫ তে দুইজন ওয়ার্ড বয় এসে আমাদের মালামালগুলো ট্রলিতে করে আমাদের সাথে নিয়ে ওয়ার্ডে পৌছে দিলো।

ওয়ার্ডে পৌছে দেখি আমার স্ত্রী একটি বেডে জীর্ণ হয়ে শুয়ে আছে। রাতভর ঘুমায়নি, ওয়ার্ডের সাথে তার অবস্থাও বিধ্বস্ত। এমন পরিস্থিতিতে মালামালগুলো এক পাশে রেখে বাবাকে টয়লেট করিয়ে বিছানায় একটা চাদর পেতে ঘুমাতে দিলাম। কেউ সারা রাত ঘুমায়নি। বাবা, মীম সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলো। আমি এর মাঝে ওয়ার্ড বয় দিয়ে রুমটা পরিস্কার করে সব কিছু গুছিয়ে নিলাম।

এই অবস্থাটা একটু কঠিন। এখানে মন আর শরীরকে শক্ত রেখে কাজ সেরে নিতে হয়। আবার নিজেরও যত্ন নিতে হয়। আমি প্রথমেই বুঝে নিলাম এটা নেগেটিভ ওয়ার্ড। বেশী দিন এখানে রাখবে না। তাই কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ আর কিছু মালামাল বের করে রুমটা গুছিয়ে আশপাশের পরিবেশটা চিনে নিলাম।

বাবা আর আমার যেহেতু পেটে সমস্যা, তাই ওয়াশরুমটা দেখে পরিস্কার করিয়ে নিলাম। এখানের ওয়ার্ডগুলোতে হাই কমোড নেই। কেবিনগুলোতে হাই কমোড আছে। কিন্তু কেবিনে এক বা দুটি বেড। আমরা তিনজন মানুষ পাশাপাশি, বাবা যথেষ্ট আনস্ট্যাবল। উনার পাশেই সারাক্ষণ থাকা লাগে। আবার মীমকেও একা রাখা যাবে না। পুরো ওয়ার্ডটাতেই যেহেতু আমরা আছি আর সামনে খোলা বড় বারান্দা, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানেই থাকবো আমরা।

৫ম তলার এই পরিবেশটা ভিন্ন। ফ্লোরে ঢুকে লম্বা করিডোরে দেখলাম, সবাই হাটাহাটি করছে। এক দুই জন বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী এক সাথে তসবি নিয়ে ধীরে ধীরে হাটছেন। ৪ জন নারীকে দেখলাম এক সাথে গল্প করছেন আর হাটাহাটি করছেন। বেশ কিছু তরুণ তরুণীও নিজস্ব দল পাকিয়ে হাটাহাটি করছেন। সবাই মাস্ক পরা। নিজেদের মাঝে কিছুটা দূরত্ব আছে তবে কোনো জড়তা নেই। কারণ সকলেই কোভিড পজেটিভ। সকলেই বাচার লড়াইয়ে শামিল হলেও মনে হচ্ছে, এখানকার মানুষগুলো দীর্ঘ দিন পর মুক্তি পাওয়া মানুষ। এতদিন যারা ভয়ে সংকোচে ঘরে একাকী জীবনযাপন করেছেন, এখানে এসে যেন তারা কিছুটা মুক্তি পেয়েছে।

আমরা রুমে পৌছানোর পর আগের মতোই বেডগুলোতে চাদর বালিশ বিছিয়ে রুমটা গোছানো শুরু করলাম। এখানে আল্লাহ চান তো অন্তত ১৫-২০ দিন থাকা লাগবে। তাই প্রয়োজনীয় সব কিছু বের করে রাতের খাবারে আগেই রুমটা আরামদায়ক করে নিলাম। রাতে আগের মতোই নার্স এসে বাকিদের ইনজেকশন আর সবাইকে প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে গেল। এখানে ওষুধ দেবার সিস্টেমটা ভিন্ন। পলি ব্যাগে সিনথেটিক স্টিকারের উপর নাম, বেড লেখা থাকে। তার ভেতর থাকে ওষুধ। প্রতিটা ওষুধ কয়েক পাতা সিনথেটিক টেপ দিয়ে মোড়ানো থাকে, তার উপর কাগজ দিয়ে স্ট্যাপল করা। কাগজে লেখা থাকে ওষুধটা কখন কয়টা খাবেন। কন্ট্রোল রুমে রোগীর রিপোর্ট ফাইল থাকে।

ফাইল দেখে রোগীর জন্য একটা ওষুধের প্যাকেট করা হয়। তার উপর নাম, বেড নং লিখে নার্সদের দিয়ে পাঠানো হয়। কোনো ওষুধ নিয়ে আপনার সন্দেহ জাগলে আপনি কন্ট্রোল রুমে ডিউটি ডাক্তারকে ফোন দিয়ে জানালে তারা ফাইল দেখে বিষয়টা পরিস্কার করে। এখান থেকে শুধু কোভিডের ওষুধই না বরং রোগী আগে কোনো নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে তাও বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবে ডাক্তার কে জানাতে হয় যে সে কি কি ওষুধ প্রতিদিন খায়। তবে যারা ইনসুলিন নেন কিংবা অন্য কোনো দামী ওষুধ সেবন করেন তারা তাদের নিজস্ব ওষুধ সাথে নিয়ে আসাটাই ভালো। সব ওষুধ যে সরবারহ সবসবময় সাথে সাথেই করতে পারবে এমন বলা যায় না। তবে কোভিড রিলেটেড ওষুধ সবসময় সরবরাহ করা হয়।

রাতে খাবার পূর্বে প্রান্তিক এসে কিছুক্ষণ গল্প করে গেলো। তার বাবার অবস্থা জানালো। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম উকিল শেরপুরের নালিতাবাড়ি পৌরসভার সাবেক মেয়র। তিনি আইসিইউতে থাকতে চান না। রেগুলার ওয়ার্ডে যেতে চান। কিন্তু তার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কম। আর যে পরিমান অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে তা আইসিইউ ব্যতীত সরবরাহ সম্ভব না। প্রান্তিকের বোন নওরিনও আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে যেন তার বাবাকে যেন বুঝানো হয়। কিন্তু তিনি কারও কথা শুনতে নারাজ।

রাতের খাবার শেষে আব্বাকে ওষুধ খাইয়ে আমি ও মীম গারগেল করে শুয়ে রইলাম। সাড়ে ১০-১১টার মাঝে নার্সরা এসে আব্বাকে রক্ত তরল করার ইনজেকশন দিয়ে গেলো। আমরা ঘুমিয়ে গেলেও মাঝরাতে আব্বাকে টয়লেটে নিয়ে যেতে হয়। আমি অবশ্য ঐ সময় আরেকটা কাজ করে ফেলি। আব্বাকে টয়লেট করিয়ে নিয়ে এসে নিজে কয়েক রাকাত নামাজ আদায় করে ফেলি। কিছুটা সময় আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীনের সঙ্গে কাটাই। এতে মনে শান্তি আসে।

এখন কিছুটা গোছানোর পালা। আব্বা কিছুটা স্ট্যাবল হয়েছে কিন্তু মীম আর আমেনার শরীর খারাপের দিকে। পেটে সমস্যা শুরু হয়েছে তাদের। আগে যে টুকটাক সহযোগিতা পাওয়া যেত এখন তাও বন্ধের মুখে। মনে মনে তিন জনকে সহযোগিতা করার প্রস্তুতি নিলাম। কিছু প্ল্যান করে নিলাম। এখন আর আগের মতো অগোছালো কিছু করা যাবে না। সময় বেঁধে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আর সবাইকে সময়মতো সব কাজ করিয়ে নিতে হবে। তাই ভোর ৭ টার ঘুম থেকে উঠে ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি গরম করলাম।

আব্বাকে ঘুম থেকে তুলে গারগেল করিয়ে ফ্রেশ করালাম। আমিসহ বাকিদেরও তাই করালাম। পৌনে আটটায় নাস্তা এলো। সবাই নাস্তা খাবার পর ১০টা পর্যন্ত রেস্ট তারপর সবার ভাপ নেবার জন্য পানি গরম করলো আমেনা। আমি মাল্টা কাটি সবার জন্য। আব্বা, মীম, আমেনার ছুরি, কাচি ধরা নিষেধ। তাদের রক্ত তরল করার ইনজেকশন দেওয়া হয় বলে তাদের হাত বা অন্য কিছু কেটে গেলে রক্ত থামানো যাবে না। মাল্টা ও হালকা শুকনো খাবার খাওয়া শেষে ভাপের পানি এসে যায়। সবাই ভাপ নেওয়ার পর মীম গোসল করে নেয়।

এর মাঝে ডাক্তার এসে ভিজিট করে, নার্সরা এসে তাদের কাজ সেরে যায়। ডাক্তার নার্সরা সাধারণত সাড়ে ১২টার ভিতর তাদের ডিউটি সেরে যায়। সবাই বেশ কাছে থেকেই আন্তরিকতার সাথে (কোভিড রোগীর জন্য যতটা সম্ভব) তাদের নিজ নিজ কাজ করে। আবার কন্ট্রোল রুম থেকে ফোন দিয়ে খোজও নেয়। কন্ট্রোল রুমগুলোর নম্বর প্রয়োজন অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে সব রুমে লাগানো আছে।

আব্বা এতে মনে সাহস পায়। কোভিড রোগীর জন্য মনোবলটা অনেক জরুরী। নিরাপদ স্থানে আছি এমন ভাবনাই রোগীকে দ্রুত সুস্থ্ করে তুলে। মনোবল ভেঙ্গে গেলে ভাইরাস পেয়ে বসে। প্রতিদিন রুম ক্লিনার, ওয়াশরুম ক্লিনার এসে পরিষ্কার করে যায়। রুম পরিষ্কার যে করে তার নাম সূবর্ণা। সে বেশ হাসি খুশি। সুন্দর করে সবার খোজখবর নেয়। রুম পরিস্কার করতে করতে অনেক কথা বলে। তার মনে ভয় ডর কম। সুযোগ পেলে পিপিই খুলেই রুম পরিস্কার করতো!

আজ হঠাৎ রাত ১২ টায় ভাগ্নি নওরিনের ফোন। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মামা তুমি একটু প্রান্তিককে নিয়ে আইসিইউতে যাও। আব্বুর কী জানি হয়েছে। আইসিইউ থেকে ডাক্তার ফোন দিয়েছিল। আমি ঝটপট মাস্ক পরে দৌড়ে চার তলায় নেমে যাই। প্রান্তিককে ফোন দিয়ে ওয়ার্ড থেকে বের করে আইসিইউ ফ্লোরে যাই। ফ্লোরের সিঁড়িতে দাড়িয়ে আইসিইউ ডাক্তারদের ইশারা করলে তারা একজন নার্সকে পাঠান।

নার্স বাইরে এসে জিজ্ঞাস করেন, এখানে কি? আমরা পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাস করি ৬ নং বেডের রোগীর কি হয়েছে। নার্স বেড থেকে ঘুরে এসে ভাবলেশহীনভাবে বলেন, দুঃখিত ঘণ্টাখানেক আগে উনি মারা গেছেন। আপনারা চলে যান। সকালে মারজাকুল থেকে লোক এসে সব কাজ শেষ করে লাশ হস্তান্তর করা হবে। প্রান্তিক হাউমাউ করে কান্না শুরু করলে আমি তাকে সামলে আমার ঘরে নিয়ে আসি। বারান্দায় বসিয়ে আমি আর মীম মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। পানি খাওয়াই। এর মাঝে আব্বা ঘুম ভেঙ্গে বিষয়টা টের পেয়ে যান। উনি সম্ভবত একটু ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যান। রাত দুইটার দিকে প্রান্তিক তার নিজ ওয়ার্ডে চলে যায়। আমি হাত-পা ধুয়ে শুয়ে পড়ি। সকালে উঠে প্রান্তিক আর তার আব্বুকে বিদায় দিতে হবে। শোবার পর নানা চিন্তা মাথায় ভর করে। মৃত্যু কত নির্মম! তার থেকে নির্মম করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। সন্তান হয়ে কাছে যাওয়া যায় না। এক নজর দেখা যায় না। মামা হিসাবে আমার কত দায়িত্ব ছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। আমারও যে হাত-পা বাধা!

৫ জুলাই সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রান্তিককে ফোন দিলাম। প্রান্তিক জানালো, লাশবাহী গাড়ি এলে সে জানাবে। আমি ঝটপট নাস্তা করে ঘরের কাজগুলো সেরে নিলাম। সাড়ে ১০টায় প্রান্তিক ফোন দিলো। আমি তখন আব্বাকে নিয়ে ওয়াশরুমে যাচ্ছি। আব্বাকে ফ্রেশ করিয়ে ঝটপট নিচে নেমে গেলাম। গেইটে সিকিউরিটি আটকাতে চাইলো। আমি বললাম, আমার বোনের হাজব্যান্ডকে বিদায় দিতে হবে। সিকিউরিটি আর আটকালো না। নিচে নেমে দেখি প্রান্তিকরা প্রায় বিদায় নিচ্ছে। কোনোভাবে এম্বুল্যান্সের ভিতর থেকে দুলাভাইয়ের প্যাকিং করা নিথর দেহটা দেখে প্রান্তিক আর তার বোন নওরিনকে বিদায় দিলাম । উপরে এসে ফ্রেশ হলাম। আব্বা চুপচাপ, রুমের মাঝে থমথমে অবস্থা। আব্বা সারাদিন কারও সাথে তেমন কথা বলেননি।

এখন আব্বার পেটের পীরা একটু ঠিক হয়েছে। অন্যরাও একটু একটু স্ট্যাবল হচ্ছে। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। হাসপাতালের এক রোগীর নাম জালাল। শক্ত সামর্থ্য মাঝবয়সী। সারা দিন ওয়াশরুমে দৌড়াদৌড়ি করেন, ইন্টারেস্টিং চরিত্র। সারাক্ষণ বাথরুম পরিস্কার করেন। পাশের রোগীদের সহযোগিতা করেন। বেশিরভাগ সময় তাকে ধোয়া- মোছাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখি। উনার বেড ওয়ার্ডে নাকি বাথরুমে তা বুঝা মুশকিল!

হাসপাতাল জীবনে এই প্রথম কাউকে অন্যের ওয়াশরুম ধোয়ামোছা করতে দেখলাম। দেখা হলে বলেন, গত কয়ডা মাস সব ধুয়ে ফেল্লাম। কিন্তু লাভ কি? আইতেই হইলো। বলতে বলতে আবার ধুতে থাকেন। এখানে এভাবেই দিন-রাত কাটছে। মীমের শরীরটা একেক দিন একেক রকম। কখনো বুকে ব্যথা, কখনো জ্বর, মাথাব্যথা ইত্যাদি। আব্বার পেটের সমস্যা ব্যতীত সব ঠিক আছে। সব কিছু নিয়মিত চলছে। ডাক্তার, নার্স, ক্লিনার সময়মতো তাদের কাজ করে যাচ্ছে। ফুফু আর বোন নিত্যনতুন পদের খাবার পাঠাচ্ছে।

এভাবে ১০ দিন পার হয়ে গেল। ডাক্তার এসে ভিজিট করেন নিয়মিত। মীমের বুকের ব্যথার জন্য তার সিটিস্ক্যানও করানো হয়। তাদের মূলত দেখার বিষয়, শ্বাসকষ্ট হয় কি না। কিংবা অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক আছে কি না। এই দুইটা না থাকলে তারা আর বেশী চিন্তা করেন না।

হাসপাতালের করিডোরে একটি অভিযোগ বক্স রাখা হয়েছে। আমার কোনো কিছু প্রয়োজন হলে কন্ট্রোল রুমে জানিয়ে দেই। তারা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করে। তাই অভিযোগ নেই। তবে কিছু পরামর্শ আছে। কন্ট্রোল রুম আর নার্স স্টেশনের মাঝে কিছু সমন্বয়হীনতা আছে। নার্সরা ওষুধ আর ইনজেকশন দেবার কাজটা ভালো মতো করে। কিন্তু রোগী অনুযায়ী ওষুধের প্যাকেটে ওষুধ ও নির্দেশিকায় মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে। নার্সরা প্রতিদিন ডিউটিতে শুধু ওষুধ আর ইনজেকশন নিয়ে আসে।

কিন্তু অনেক রোগীর হাতে ক্যানোলা লাগানো, সেগুলো পরিবর্তন করতে হতে পারে বা নতুন সিনথেটিক স্টিকার লাগানোর প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু সেই প্রস্তুতি তারা নিয়ে আসে না। এমনকি রোগী রিলিজ হবার দিন সকালেও তারা তা খুলে দিয়ে যায় না। কন্ট্রোল রুম আর নার্স স্টেশনের মাঝে সমন্বয়হীনতা কমানো গেলে, তারা আরেকটু দায়িত্বশীল হলে হয়তো রোগীদের এ দুর্ভোগও থাকবে না।

লেখক : ডিরেক্টর, ডেল্টা হেলথ কেয়ার