প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

কী মধু আছে ওই ক্যাডারে?

০৩ এপ্রিল ২০২১ ২০:০৭:৫৮ | আপডেট: ৩ years আগে
কী মধু আছে ওই ক্যাডারে?

ডা. পলাশ বসু

 

চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, ফার্মাসিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, কৃষিবিদ, ফিজিসিস্ট বা এ রকম কঠিন পেশায় ক্যারিয়ার তৈরি করার স্বপ্ন নিয়ে একটা ছেলে বা মেয়ে ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পেছনে অনেক সময় ব্যয় করে থাকে। তারপর ব্যাপকতর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাইন্সের কঠিন সাবজেক্টে চান্স পায়। পরিবারসহ সবাই খুব খুশি হয়। তার মেধার প্রশংসাও করে। করাটাই স্বাভাবিক। এটা খুবই ভালো কথা। আর এ প্রক্রিয়ার কথা আমরা সবাই-ই জানি।

মেধাবী এই তরুণ-তরুণীরা ভর্তির পরই পড়ে যায় মূলত এক দুর্বিষহ জীবনের মাঝে। সারাক্ষণ পড়াশোনা, পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। আর এ সময়ে তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অন্য সাধারণ বিষয়ের অধিকাংশ বন্ধুরাই আরাম আয়েশে থাকে। ঘোরেফেরে, হৈ হুল্লোড় করে। পরীক্ষার আগে পড়লেই তাদের হয়ে যায়। কোন সাবজেক্টকে ছোট বা হেয় করার জন্য আমি এ লেখা লিখছি না। দয়া করে সেটা ভাববেনও না। আমার উদ্দেশ্যেটা আসলে মেধাবী তরুণ-তরুণীদের অবমূল্যায়ন কিভাবে হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে, সেটা সামনে টেনে আনা। আর তার জন্য আমাদের সিস্টেম কতটা দায়ী, সেটা তুলে ধরার জন্যই আমি এ লেখা লিখছি।

ধরুণ একজন চিকিৎসকের কথাই বলি, যেহেতু আমি পেশায় একজন চিকিৎসক। বর্তমানে মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা পেশায় আছি। ফলে এর ভেতর-বাইর আমি অনেককিছু জানি। অন্য পেশা যেমন ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, ফার্মাসিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট বা এরকম পেশাজীবী হওয়ার পড়াশোনার বিষয় আমি সম্যক জানি না বিধায় সেগুলো পড়া কষ্টের ঠিকই কিন্তু সেটা কতটা আমার জন্য সত্যিই কষ্টকর বিষয়। তাই আমার পেশাকেই উদাহরণ হিসেবে সামনে আনলাম।

আপনারা এমবিবিএস কোর্স সম্পর্কে কতটা জানেন বা আদৌ জানেন কি না, আমি ঠিক জানি না। তবে আপনারা সবাই এক বাক্যে এটা বলে থাকেন যে, ডাক্তারি পড়াটা খুবই কঠিন কাজ। সারাক্ষণ পড়াশোনার উপরে থাকতে হয়। আর সেটা সারা জীবনই করতে হয়। যাই হোক, একটু ধারণা দিই আগে। এখানে প্রফেশনাল পরীক্ষা (বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হয়) নামক চারটি কষ্টকর পরীক্ষা (আগে ছিল তিনটি। আগে এসব পরীক্ষায় পাস নম্বর ছিল ৫০ শতাংশ) তা উৎরাতে হয়। পাস নম্বর কত জানেন? ৬০ শতাংশ। হ্যাঁ, এখন তা ৬০ শতাংশ। তাও আলাদা আলাদাভাবে লিখিত, মৌখিক এবং ব্যবহারিক পরীক্ষায় পেতে হবে। ধরা যাক, কোনো একটাতে আপনি ৬৫ পেলেন আর একটাতে ৫৫ পেলেন। এভারেজে যে ৬০ হলো তা হলেও হবে না। একদম আলাদা আলাদাভাবে তিন জায়গাতেই-লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিকে ৬০ নম্বর করে পেতে হবে। এর সাথে মেডিকেল কলেজে ইন কোর্স সপ্তাহে, মাসে আরও কত যে পরীক্ষা আছে তা আর নাই বা বলি।

এভাবে ৫ বছর শেষ করার পরে আরও ১ বছর সফলতার সাথে ইন্টার্নি শেষ করে তবেই নামের আগে ডাক্তার লেখার সুযোগ হয়।

এরপর শুরু হয় আরেক জীবন। বলা যায়, আসল খেলা। আগেরটা মনে করেন যে, ওয়ার্ম আপ খেলার মতো। ডাক্তার তো হয়ে গেলেন। এখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান (এমডি, এমএস, এফসিপিএস, ডিপ্লোমা) করতে হবে। না হলে তো ‘সিম্পল’ এমবিবিএসকে জনগণ আবার দাম দেন না। যাক এসব ডিগ্রিতে চান্স পাওয়ার জন্য আবার পরীক্ষা দিতে হয়। বোঝেন তাহলে কতটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা-কারণ এখন সব এমবিবিএস পাস করা কথিত ‘সিম্পল’ ডাক্তারদের ভেতরে আবার প্রতিযোগিতা হবে।

তারপর চান্স পেলে তো ভালো। না হলে আবার পরীক্ষা দাও। আর যারা চান্স পেল, তারা বিনা বেতনে হাসপাতালগুলোতে ‘অনারারী’ চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। আমরা ডাক্তাররা দুঃখে এটাকে বলি ‘অনাহারি’ চিকিৎসক। এখন যদিও রেসিডেন্সি কোর্সে ২০ হাজার টাকার সম্মানি চালু হইছে। আগে একদম ‘নো টাকা’ ছিল।

এর মাঝে আবার বিসিএস আসে। নিবে তো অল্প ডাক্তার। তার জন্য পড়তে হবে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য পড়তে হবে। হাসপাতালে ডিউটি করে কোনো মতে মাসের খরচ জোগাড় করতে হবে। এভাবে চলবে মিনিমাম আরেও ৭ বছর। অনেকের ১০ বছর। অনেকের আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করাই হয়তো হয় না ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নানামুখি বাস্তবতায়। সেটা না করতে পারলে আজীবন আপনি থেকে যাবেন মেডিকেল অফিসার। এই একটাই ‘অফিসার’ পোস্ট আছে, যাদের উচ্চতর ডিগ্রি না নিলে জীবনে আর কোনো প্রমোশন হবে না!

ঠিক সে সময়ে এই ডাক্তার বা অন্য পেশাজীবী যাদের কথা শুরুতেই বলেছি, তাদের ভার্সিটিতে অন্য বিষয়ে পড়া বন্ধুটি কিন্তু বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৪ বছরের অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে, এই সার্টিফিকেট দিয়েই বিসিএস পরীক্ষায় বসে যায়। সাথে অন্য চাকরির পরীক্ষাও দিতে থাকে। তারপর বিসিএস হয়ে যায়। না হয় অন্য কোনো সরকারি চাকরিতে ঢুকে যায়। বিয়ে করে। আনন্দময় জীবন কাটায়। ব্যাংকে ঢুকলে অল্পসুদে বাড়ি করার জন্য লোন পায়। প্রশাসন, পুলিশ, কর বা অন্য কোনো পেশায় ঢুকে ক্ষমতা ও সম্মান দুটোই জমিয়ে উপভোগ করতে থাকে। আর সে সময়ে তাদের ডাক্তার বা অন্য পেশাজীবী বন্ধুটি মাত্র তাদের ডিগ্রি হতো শেষ করে নিজের পেশাগত লাইনে কিছু একটা করার প্রানান্তকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

ডাক্তাররা এমবিবিএস শেষ করে ক্লিনিকে ‘খ্যাপ’ মেরে মাসের খরচ চালানোর বন্দোবস্ত করে। আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য পড়তে থাকে। এ সময়ে না থাকে তার কোনো পারিবারিক জীবন! না থাকে কোনো সামাজিক জীবন! সম্মান, অর্থ, ক্ষমতা তো দূর কী বাত! অনেক ছেলে চিকিৎসক বিয়ে করারও সাহস করে না। কারণ সে নিজেই চলতে পারে না। সংসার কীভাবে চালাবে বলেন? আজিজ সুপার মার্কেটে, বিএসএমএমইউ এর লাইব্রেরিতে গেলেই এই অভাগা কিন্তু সমাজস্বীকৃত ‘মেধাবীদের’ দুর্দশা চাইলে নিজের চোখে দেখে আসতে পারেন।

এমন বাস্তবতায় আমার কৃষিতে পড়া বন্ধুটি যখন ‘কৃষিবিদ’ না হয়ে সোনালী ব্যাংকে চাকরিতে ঢুকে, তারপরে নিয়মমতো স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে লোন পেয়ে জেলাশহরে জায়গা কিনে বাড়ি করে সুখে থাকার সুযোগ করে নেয়, তাকে কি আমি বা আপনি দোষ দিতে পারি কেন সে তার পেশায় থাকল না এটা বলে? আমার ‘বুয়েটিয়ান’ বন্ধু যখন বেসরকারি চাকরির ইন্টারভিউয়ে গিয়ে তাতে ঢোকার সুযোগ না পেয়ে সিঙ্গাপুরে এমএস করে পরে আমেরিকাতে পিএইচডি করে সেখানে নাগরিকত্ব নিয়ে সেটেল্ড হয়ে যায়, বাড়ি কিনে তখন তাকে কি দোষ দিতে পারবেন? অন্যদিকে, আমার স্কুলের একজন জুনিয়র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এডমিনে ঢুকে সেই স্কুলের সিনিয়রদেরকেই অসৌজন্যতা দেখায়, তখন যদি মনের ভেতরে নিজের পেশা বাদ দিয়ে ক্যাডার হওয়ার দিকে কেউ ঝুঁকে পড়ে তাকে তখন দোষ দিতে পারবেন আপনি? বলুন পারবেন?

এই যে ৩৮ বিসিএসে প্রায় ৪০ জন চিকিৎসকসহ আরও অন্য পেশাজীবীরা (সে সংখ্যা অবশ্য জানি না) কথিত ক্ষমতাধর ক্যাডারে চলে গেলে এর দায় কার? এই মেধাবীদের কাছে আমাদের সমাজ কি নানা সময়ে এই বার্তা দেয়নি যে, তুমি ক্ষমতাহীন! তুমি কষ্ট করে পেশার জন্য শ্রম দিচ্ছো আর তোমারই বন্ধু সরকারি চাকরিতে ক্যাডার বা নিদেনপক্ষে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে (এখন অবশ্য গ্রেডিং) ঢুকে ক্ষমতা শো করে, তখন কি ওই পেশাজীবীর ভেতরে হতাশা আসে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছেলে বা মেয়েটি কেন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হয়ে প্রশাসন ক্যাডার, পুলিশ, ট্যাক্স এসবে আসতে চায় বলুন তো? এসব প্রশ্নের উত্তর মনে হয় খোঁজার সময় এসে গেছে এখন।

একবার ভাবুন প্লিজ, সমাজকে আমরা অর্থ আর ক্ষমতার কাছে যেভাবে নত হতে দেখছি, তা যদি এমন করে চলমান থাকে তাহলে আগামীতে কোনো মেধাবী ছেলেমেয়ে কি আর পেশাজীবী হতে আসবে? কারণ তারা তো বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ বিষয়ে ভর্তি হয়েই ক্যাডার হওয়ার জন্য প্রস্ততি নিতে পারবে সহজেই। আয়েসেও শিক্ষাজীবন পার করতে পারবে। তাহলে অহেতুক জটিল পড়ালেখা তারা করতে কেন উৎসাহিত হবে বলুন?

ফলে পেশাগত এসব জায়গায় যে শূণ্যতা সৃষ্টি হবে, তা পূরণ করা কি কখনো সম্ভবপর হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ছেলে বা মেয়েটি যদি সেখানে শিক্ষক না হয়ে ক্যাডার হতে উদগ্রীব থাকে তাহলে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভাবতে পারেন? এমনিতেই আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ পর্যায়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরা শিক্ষকতা পেশায় আসে না। এর কারণ কি খুঁজে দেখেছেন? খুঁজে দেখেছেন তাহলে কারা আসছে মানুষ গড়ার এ পেশায়?

তাই এখনো সময় আছে। আসুন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়ে মেধাভিত্তিক প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থাসহ সব জায়গাতে পরিবর্তন আনি। না হলে দৃশ্যত উন্নয়নের সোপান তৈরি হবে ঠিকই তবে তা টেকসই হবে না। এই বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসান হওয়া আশু দরকার কি না, আসুন সে প্রশ্ন করি নিজের বিবেকের কাছে। করণীয়ও হয়ত তাতে মিলতে পারে সহজেই।

ডা. পলাশ বসু : চিকিৎসক ও শিক্ষক