প্রচ্ছদ ›› মতামত-বিশ্লেষণ

কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয় সামাজিক মাধ্যমে

০৩ এপ্রিল ২০২১ ২০:১৫:৪৮ | আপডেট: ২ years আগে
কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয় সামাজিক মাধ্যমে

ক্লে শারকি

 

সামাজিক মাধ্যম তাত্ত্বিক ক্লে শারকি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট প্রযুক্তির সামাজিক ও অর্থনেতিক প্রভাব বিষয়ে গবেষণা ও লেখালেখিতে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি ফরেন পরিলিসর শীর্ষ শত বৈশ্বিক চিন্তকের তালিকায় তার নাম ছিল। শারকি ২০০৯ সালের জুনে টেড প্ল্যাটফর্মে তিনি এই বক্তৃতা করেন। বক্তৃতাটি বাংলায় ভাষান্তর করার জন্য শারকি অনমুতি দিয়েছেন দৈনিক আমাদের সময়কে।

ধারাবাহিক তিন পর্বের রচনার শেষ পর্ব এটি—

যোগাযোগ মাধ্যমে যে পরিবর্তন এসেছে, এর প্রভাব শুধু তাদের ওপর পড়েনি যারা তথ্য ও মতামতকে দমন করতে চায়। যারা বার্তা প্রেরণ করতে চায়, তাদের ওপরও এ পালাবদলের প্রভাব পড়েছে। কেননা, এ পরিবর্তন কোনো নির্দিষ্ট একটা কৌশল নয়, বরং এটা সামগ্রিকভাবে তথ্য-বাস্তুসংস্থানের রূপান্তর। বিশ শতকে আমরা কী দেখেছি। ধরা যাক, একটা সংস্থা কোনো বার্তা একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রান্তিক ব্যক্তিগুলোর কাছে পৌঁছতে চায়। এরকম ক্ষেত্রে বিশ শতকে যা হতো : বার্তা তৈরি করুন। সবাইকে একই বার্তা পাঠিয়ে দিন। জাতীয় বার্তা। অভীষ্ট গ্রাহক। তুলনামূলকভাবে বার্তা রচয়িতা কম। বার্তা প্রেরণ ব্যয়বহুল, ফলে প্রতিযোগিতাও কম। বিশ শতকে জনগণের কাছে বার্তা পৌঁছাতে হলে এটাই ছিল উপায়। কিন্তু দিন বদলে গেছে।

আমরা ক্রমশ এমন একটা দৃশ্যপটে এগুচ্ছি, যেখানে যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বিশ্বজনীন ও সামাজিক এবং সর্বব্যাপী ও সাশ্রয়ী। এখন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান যারা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উদ্দীষ্টগোষ্ঠীর বার্তা ছড়িয়ে দিতে চায়, তারা এখন এ পরিবর্তনকে কাজে লাগাচ্ছে। এখন বার্তাগ্রাহক ফিরতি বার্তা পাঠাতে পারে। কিছুটা উদ্ভট ঠেকছে? সমস্যা নেই, অন্যদের মতো আপনিও এ পরিবর্তনে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।

কিন্তু পট পরিবর্তনের এটাই আসল চিত্র নয়। আসল পরিবর্তন তো হলো এই যে, এখন কেউ আর কারো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আগের গ্রাহক বা ভোক্তারা এখন নতুন সৃজনকর্তা। এখন বার্তাগ্রাহকেরা একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারে। এখন পেশাদার ব্যক্তির চেয়ে অপেশাদার ব্যক্তি বেশি। পরিসর আরও বিস্তৃত। নেটওয়ার্কের জটিলতা সংযুক্ত গ্রাহকের সংখ্যার বর্গের সমতুল্য। মানে, পরিসর যখন বাড়তে থাকে, তখন তা অনেক অনেক গুণে বিস্তৃত হয়।

গত দশকেও আমরা দেখেছি, জনসাধারণরে ব্যবহারের জন্য যে মিডিয়া ছিল, তা চালাত পেশাদার ব্যক্তিরা। কিন্তু সেই দিন চলে গেছে। ফিরে আর আসবে না কখনও। সামাজিক মাধ্যমের দিন শুরু হয়েছে এখন। সামাজিক মাধ্যম হলো মুক্ত কথামালার উৎস।

এ নিয়ে একটা গল্প বলে শেষ করব। ওবামার নির্বাচনী প্রচারকালে আমরা সামাজিক মাধ্যমের অন্যরকম এক ব্যবহার দেখেছি।

আমি কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের রাজনৈতিক ব্যবহারের কথা বলছি না। আমি আসলে সামগ্রিকভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের কথা বলতে চেয়েছি। ওবামা বা তার প্রচারশিবির একটা কাজ খুব দারুণভাবে করেছিল। তারা ‘মাই বারাক ওবামা ডট কম’, সংক্ষেপে ‘মাইবো ডট কম’ সাইটটি সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক করেছিল। লাখো লাখো নাগরিক এতে যুক্ত হয়েছিল। কীভাবে ওবামাকে সাহায্য করা যায়, লোকে সেখানে পরামর্শ দিত, এমনকি নিজেরাও সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। অবিশ্বাস্যরকম আলাপ-আলোচনার একটা ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল নেটওয়ার্কটি। [৮]


যোগাযোগ মাধ্যম এখন বৈশ্বিক ও সামাজিক, সর্বব্যাপী ও সাশ্রয়ী। অলঙ্করণ : রিসার্চ লিপ

এরপর কী হলো, গত বছর ওবামা বললেন, ফিসা (ফরেন ইন্টেলিজেন্স সারভেইল্যান্স অ্যাক্ট) আইন নিয়ে তিনি মনোভাব বদলেছেন। জানুয়ারিতে তিনি বলেছিলেন, তিনি এমন কোনো বিলে সই করবেন না যা আমেরিকার নাগরিকের ওপর বিনা পরোয়ানায় নজরদারিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়মুক্তি দেবে। কিন্তু গ্রীষ্মে, নির্বাচনী প্রচারের মাঝামাঝি সময়ে এসে, তিনি বললেন, ‘আমি বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি। মত বদলেছি। আমি এই বিলের পক্ষেই ভোট দিব।’ এ কথা শুনে তার বহু সমর্থক তারই সাইটে প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝাড়তে ছাড়েনি।

সাইটে গ্রুপটার নাম প্রথমে ছিল ‘সিনেটর ওবামা’। পরে তারা নাম বদলায়। নতুন নাম রাখে ‘প্লিজ গেট ফিসা রাইট’। গ্রুপটি খোলার কয়েকদিনের মধ্যেই মাইবো ডট কমে এটি সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান গ্রুপে রূপ নেয়; কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় গ্রুপ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। একটা সময় ওবামাকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করতে হয়েছিল। তাকে সমর্থকদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছিল। তিনি ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিলেন, ‘আমি বিষয়টা পুনর্বার বিবেচনা করে দেখেছি। আপনাদের ক্ষোভের কারণ আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তারপরও আমি এই বিলের পক্ষে ভোট দিব, যেমনটা আমি বলেছি। আমি জানি, আপনারা অনেকে হয়তো আমার সাথে একমত না। তারপরও আমি এই বিষয়ে নিজের মতটাই বহাল রাখছি।’

এতে কেউই খুশি হলো না। কিন্তু গ্রুপের কথোপকথনে মজার একটা বিষয় ঘটল। গ্রুপের লোকেরা উপলব্ধি করল, ওবামা তো তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। ওবামা প্রচারশিবিরের কেউই গ্রুপটা গোপন করার চেষ্টা করেনি কিংবা এতে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে কঠিন করেনি। তারা সমালোচনাগুলো গোপন করার বা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। মানুষ বুঝতে পারল, মাইবো ডটকমের মাধ্যমে প্রচারশিবির সমর্থকদের সাথে সমবেত হতে চেয়েছিল, এ প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করা নয়, মোটেও।

এটাই হলো মিডিয়া বা যোগাযোগ মাধ্যমের সত্যিকার পরিপক্ক ব্যবহার। পেশাদাররা আমজনতার কাছে বার্তা প্রচার করবেন—প্রচলিত ধারার যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা পরিচিত এই চিত্রটাই দেখে এসেছি। কিন্তু সে জায়গা থেকে সরে গেছে মিডিয়া। যোগাযোগ মাধ্যম এখন বৈশ্বিক ও সামাজিক, সর্বব্যাপী ও সাশ্রয়ী। আগে যারা শুধু বার্তাগ্রাহক ছিল, এখন তারা পুরোপুরি সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। সবার জন্য একটাই অভিন্ন বার্তার দিন এখন শেষ। আজকের যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বরং গ্রুপগুলোকে সংঘবদ্ধ করা ও সমর্থন জোগানোর জন্য অনন্য প্ল্যাটফর্ম।

কেউ যদি মনে করে তার কাছে একটি তথ্য বা বার্তা আছে এবং তিনি চান, বার্তাটা বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে যে কেউ যেন শুনতে পায়। তাহলে আজকের যোগাযোগ মাধ্যম তাকে সে সুযোগ করে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘আমরা কীভাবে সামাজিক মাধ্যমের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে পারি?’

ভাষান্তর : জাহাঙ্গীর আলম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী, এবং আমাদের সময়-এর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক।

তথ্যটীকা

[৮] ২০১১ সালে প্রকাশিত ম্যাগলবি ও কোরাডো সম্পাদিত ‘ফিনান্সিং দ্য টু থাউজ্যান্ড এইট ইলেকশন’ বইয়ে ১০০তম পৃষ্ঠায় মাইবো ডট কম সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটা ‘প্রচার কার্যক্রমে সমর্থকদের নিজেদের মনমতো অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছিল।’ এটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের ‘শৃঙ্খলিত বিকেন্দ্রীকরণ’।

 

প্রথম পর্ব : যোগাযোগে নতুন ইতিহাস নির্মাণ করছে সামাজিক মাধ্যম।

দ্বিতীয় পর্ব : যেভাবে চীনের মহা [নিয়ন্ত্রণ] প্রাচীর ভেঙেছিল সামাজিক মাধ্যম।