প্রচ্ছদ ›› আন্তর্জাতিক

আফগানিস্তানের যে এলাকা এখনও দখলে নিতে পারেনি তালেবান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৬ আগস্ট ২০২১ ১০:৩২:০৯ | আপডেট: ৩ years আগে
আফগানিস্তানের যে এলাকা এখনও দখলে নিতে পারেনি তালেবান

তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের সব এলাকা দখল করে নিলেও রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি এক উপত্যকায় তাদের যোদ্ধারা এখনও প্রবেশ করতে পারেনি। আফগানিস্তানে এখনও পর্যন্ত এটিই একমাত্র ঘাঁটি যেখানে তালেবান যোদ্ধাদের প্রতিরোধ করা হয়েছে।

শুধু এবারে তালেবান ঠেকানো নয়, গত ৪০ বছরের ইতিহাসে এ উপত্যকা বিভিন্ন সময়ে নানা বাহিনীর বহিরাক্রমণ প্রতিহত করেছে।

পাঞ্জশের উপত্যকায় ১৯৮০-এর দশকে (১৯৭৯-১৯৮৯) সোভিয়েত দখলদারিত্ব প্রতিরোধ করা হয়েছে। এসময় সোভিয়েত এবং আফগান সরকারি বাহিনীর অনেক আক্রমণ তারা ঠেকিয়ে দিয়েছে।

ইসলামপন্থী তালেবান বাহিনী ১৯৯০-এর দশকে (১৯৯৬-২০০১) যখন আফগানিস্তান দখল করে নেয়, সে সময়েও এ উপত্যকা ছিল তালেবান-বিরোধীদের একমাত্র ঘাঁটি।

"গত দুই দশকে এ উপত্যকাকে আফগানিস্তানের অন্যতম নিরাপদ অঞ্চল বলে বিবেচনা করা হয়," বলেন বিবিসির আফগান সার্ভিসের সাংবাদিক মরিয়ম আমান।

এবারেও আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে পাঞ্জশের উপত্যকা একমাত্র প্রদেশ, তালেবানের হাতে যার এখনও পতন হয়নি।

কিন্তু তালেবান বলছে, এ এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সেখানে তাদের যোদ্ধাদের পাঠানো হচ্ছে।

"তালেবানকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রতিহত করার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি," বলেছেন পাঞ্জশের অর্থনৈতিক দপ্তরের প্রধান আব্দুল রহমান।

তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন তালেবানের হাতে উৎখাত হওয়া আশরাফ ঘানি সরকারের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ।

প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর তার অনুপস্থিতিতে মঙ্গলবার তিনি নিজেকে "আফগানিস্তানের বৈধ অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট" হিসেবে দাবি করেছেন।

আমারুল্লাহ সালেহ আফগানিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তালেবানের বিরুদ্ধে পাঞ্জশের উপত্যকার এ প্রতিরোধ লড়াই-এ যোগ দেওয়ার জন্য তিনি আফগান জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বাকি দেশের জন্য পাঞ্জশেরের এ প্রতিরোধ একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, "তালেবানের সঙ্গে এক ছাঁদের নিচে আমি কখনোই দাঁড়াবো না। কখনোই না।"

বিবিসির আফগান সার্ভিসের সাংবাদিক মরিয়ম আমান বলছেন, তালেবানের বিরোধিতা করার ব্যাপারে তার এ বার্তা বহু আফগানকেই উৎসাহিত করবে।

ধারণা করা হয় যে আমারুল্লাহ সালেহ পাঞ্জশেরে আহমেদ মাসুদের সঙ্গে রয়েছেন। পাঞ্জশের উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করছে মাসুদের বাহিনী। তার পিতা আহমেদ শাহ্ মাসুদ, যিনি "পাঞ্জশেরের সিংহ" হিসেবে পরিচিত, ১৯৯০-এর দশকে তালেবান প্রতিরোধের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নর্দার্ন এলায়েন্সের একজন নেতা।

পাঞ্জশের উপত্যকায় তালেবান-বিরোধীদের নিয়ে গঠিত একটি জোটের প্রধান মাসুদ। এ জোটের নাম এনআরএফ বা ন্যাশনাল রেজিসটেন্স ফ্রন্ট অফ আফগানিস্তান।

গত সপ্তাহে মাসুদ যুক্তরাষ্ট্রের একটি পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক নিবন্ধে "আফগান স্বাধীনতার সবশেষ দুর্গ হিসেবে পাঞ্জশের উপত্যকাকে রক্ষা" করার অঙ্গীকার করেছেন।

"এ স্বাধীনতা রক্ষার" লড়াই-এ সাহায্য করার জন্য তিনি পশ্চিমা দেশগুলোকেও আহবান জানান।

কিন্তু এ পাঞ্জশের উপত্যকা এবং যে বাহিনী এ উপত্যকাকে রক্ষা করছে তাদের বিষয়ে আমরা কী জানি?

চিরাচরিত ঘাঁটি

পাঞ্জশের উপত্যকায় তালেবান-বিরোধী জোট এনআরএফের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত প্রধান আলী নাজারি বিবিসিকে বলেছেন, সরকারের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে যদিও তারা শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী, তার পরেও হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে তারা পাঞ্জশের উপত্যকাকে রক্ষা করতে প্রস্তুত রয়েছে।

তিনি বলেছেন, এ উপত্যকার স্থানীয় বাহিনী প্রশিক্ষিত এক বাহিনী। এছাড়াও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাবেক সৈন্যসহ তালেবান-বিরোধী বিভিন্ন বাহিনী সারা দেশ থেকে এ উপত্যকায় চলে আসার কারণে তারা আরো বেশি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে।

পাঞ্জশের রক্ষায় যারা লড়াই করছে যেকোনো যুদ্ধে এ উপত্যকার ভৌগলিক দিকটি তাদের জন্য বাড়তি সুবিধা।

উঁচু উঁচু খাড়া পাহাড় ও গিরিসঙ্কটের কারণে পাঞ্জশের একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছে। এ উপত্যকায় প্রবেশের পথ অত্যন্ত সরু। উঁচু পাহাড় থেকে এ পথের ওপর নজর রাখা যায়, যার ফলে এখানে কারো আসা কঠিন।

পাঞ্জশের নদী এ উপত্যকার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। উপত্যকাটি আফগানিস্তান থেকে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হিন্দুকুশ পর্বতমালার খুব কাছে।

মধ্য এশিয়া বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং তিমুরদের জন্যেও এটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ পথ।

এ অঞ্চলে আছে মূল্যবান পান্নার খনি, জলবিদ্যুৎ বাঁধ এবং বায়ু-শক্তি চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রাস্তাঘাট তৈরি এবং রাজধানী কাবুল থেকে বার্তা গ্রহণ করতে পারে এরকম টাওয়ার নির্মাণে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে অর্থনৈতিকভাবে এ উপত্যকা খুব একটা সমৃদ্ধ নয়।

"এ এলাকা গেরিলা যুদ্ধের জন্য খুবই উপযোগী। তবে কৌশলগত দিক থেকে নয়," বলেন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের একজন সাংবাদিক হারুন শফিকি।

"এটি গুরুত্বপূর্ণ কোনো বন্দরের কাছে অবস্থিত নয়, এখানে কোনো শিল্প কারখানাও নেই, আফগানিস্তানের মোট জাতীয় উৎপাদনেও এ উপত্যকা খুব বেশি কিছু যোগ করে না।"

বর্তমানে পাঞ্জশের উপত্যকায় বাস করে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ। তাদের বেশিরভাগই তাজিক এবং তাদের ভাষা ফারসি। আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা তিন কোটি ৮০ লাখ। তাদের এক চতুর্থাংশই তাজিক।

এ এলাকার লোকজন ঐতিহাসিকভাবেই তালেবান-বিরোধী।

পাঞ্জশের উপত্যকায় তালেবান-বিরোধী একজন কিংবদন্তী নেতা আহমেদ শাহ মাসুদ, যিনি মুজাহিদ গেরিলা হিসেবেও অত্যন্ত বিখ্যাত।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার দু'দিন আগে আল কায়দা তাকে হত্যা করে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তাকে ডাকা হয় "পাঞ্জশেরের সিংহ" (পাঞ্জশের অর্থ পাঁচটি সিংহ)। রাজধানী কাবুলের বিভিন্ন জায়গাতে তার ছবি দেখা যায়। পাঞ্জশের উপত্যকায় বিলবোর্ড থেকে শুরু করে স্মৃতিস্তম্ভ এবং দোকানপাটেও তার ছবি লাগানো।

"আহমেদ শাহ মাসুদ ১৯৮০-এর দশকে আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের সময় পাঞ্জশের উপত্যকাকে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন," বলেন সাংবাদিক মরিয়ম আমান।

আমান বলেন, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০০১ সাল (যখন তালেবানের পতন হয়) পর্যন্ত মুজাহিদের বিভিন্ন শাখা ও তালেবানের মধ্যে যুদ্ধে এ উপত্যকাটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

"২০০১ সালে মাসুদের মৃত্যুর পর থেকে পাঞ্জশের উপত্যকা তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার প্রতিরোধের ইতিহাস অব্যাহত রেখেছে," বলেন তিনি।

আহমেদ শাহ মাসুদ অনেক আফগান নাগরিকের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।

প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই তাকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।

দু'হাজার বারো সালে তার নিহত হওয়ার প্রথম বার্ষিকী থেকে আফগানিস্তানে ৯ই সেপ্টেম্বর (যেদিন হাতে হত্যা করা হয়) শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, "আমার নায়ক আহমেদ শাহ মাসুদের আত্মা এবং তার উত্তরাধিকারের সঙ্গে আমি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবো না। তিনি একজন কমান্ডার, কিংবদন্তী এবং পথ-নির্দেশক।"

টুইটারে তিনি লিখেছেন, "তালেবান সন্ত্রাসীদের কাছে কোনো পরিস্থিতিতে, কখনোই আমি নতি স্বীকার করবো না।"

পাঞ্জশেরের মানুষ আমারুল্লাহ সালেহ। তিনি একজন তাজিক। ১৯৯০-এর দশকে তিনি নর্দার্ন এলায়েন্সের অংশ ছিলেন।

আফগানিস্তানে কেউ কেউ আছেন যারা মুজাহিদ নেতা আহমেদ শাহ মাসুদকে যুদ্ধাপরাধী বলে মনে করেন।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০০৫ সালে একটি অনুসন্ধান চালায় এবং তাতে আহমেদ শাহ মাসুদকে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়।

অনুসন্ধানে বলা হয়, আফগানিস্তানে বিভিন্ন যুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী এসব লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিল।

কিন্তু এখন পাঞ্জশের উপত্যকায় তালেবান প্রতিরোধের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আহমেদ শাহ মাসুদের ৩২-বছর বয়সী ছেলে আহমেদ মাসুদ।

সালেহকে ১৬ই অগাস্ট তোলা ছবিতে মাসুদের সঙ্গে দেখা গেছে। সোশাল নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়া এসব ছবি থেকে ধারণা করা যায় যে তাদের মধ্যে মৈত্রী তৈরি হয়েছে।

ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক কলামে আহমেদ মাসুদ বলেছেন, আফগান সেনাবাহিনী এবং বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে তার যোদ্ধারা সামরিক সাহায্য পাচ্ছে।

"আমাদের কাছে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ মজুদ রয়েছে। আমার পিতার সময় থেকেই এসব সংগ্রহ করা হয়েছে। কারণ আমরা জানতাম যে এ দিন আসতে পারে," তিনি লিখেছেন।

তারপরেও তিনি সাহায্যের আহবান জানিয়েছেন।

"তালেবানের বিরুদ্ধে মুজাহিদের প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। কিন্তু আমাদের সাহায্য প্রয়োজন," লিখেছেন আহমেদ মাসুদ।

"তালেবানের যোদ্ধারা যদি আক্রমণ শুরু করে তাহলে তারা অবশ্যই আমাদের দিক থেকে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়বে... তার পরেও আমরা জানি যে আমাদের সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধের উপকরণ যথেষ্ট নয়।"

"পশ্চিমে যারা আমাদের বন্ধু আছে, তারা যদি অনতিবিলম্বে এসব সরবরাহ করার উপায় খুঁজে বের না করে, তাহলে এসব খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে," বলেন আহমেদ মাসুদ।