প্রচ্ছদ ›› আন্তর্জাতিক

ইমরান খানের নাটকীয় বিদায়ে কী ভাবছে বাংলাদেশের মানুষ?

১০ এপ্রিল ২০২২ ১১:১২:০২ | আপডেট: ২ years আগে
ইমরান খানের নাটকীয় বিদায়ে কী ভাবছে বাংলাদেশের মানুষ?

নূর মোহাম্মদ

নানা নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারালেন জনপ্রিয় সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান। শনিবার দিবাগত মধ্যরাতের পর অনুষ্ঠিত অনাস্থা ভোটে জাতীয় পরিষদের ৩৪২জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জনই তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। এতেই পরিসমাপ্তি ঘটে ইমরান খান অধ্যায়ের।

এটিই এখন গোটা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত খবর। প্রতিবেশি এ দেশটির প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ পূর্ণ হাবার আগেই পদ হারানো নিয়ে নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে। অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট করছেন ইমরান খানের পক্ষে, আবারও কেউ কেউ এটিকে আমেরিকার কূটকৌশল বলেও দাবি করছেন।

সিনিয়র সাংবাদিক বুলবুল আহসান তার ফেসবুকে লিখেন, স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানে তিনবার ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী। কোনো প্রধানমন্ত্রীই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি।

অপর সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ‘ইমরান খান দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন’ এমন শিরোনামের একটি খবর শেয়ার করেছেন। তার পোস্টে মাহবুব আরা নামের একজন মন্তব্য করেছেন, যদি এদেশের দোসররা তাকে ভোট দিতে পারতো, তাহলে বিপুল আস্থা ভোট পেতে কোন কষ্ট করা লাগতো না। অথচ নিজের দেশে সে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চালের শিকার।

পার্বত্য নিউজের সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশ এ নিয়ে বিশাল এক পোস্ট দিয়েছেন, তিনি তার ফেসবুকে লিখেন- ইউএসএ, ইসরাইল, ওয়েস্টার্ন, ইন্ডিয়ার চোখে ইমরান খানের প্রধান দোষ কি? তিনি মুসলিম ভাতৃত্বের কথা বলেছেন, মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন, পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী নীতি ইসলামোফোবিয়ার মুখোশ উন্মোচন করেছেন বিশ্বসভায়। তিনি আমেরিকা ও ইসলামবিরোধী শক্তির ক্রীড়নক হতে চাননি। তার মত করে এভাবে যুক্তি দিয়ে বিশ্বসভায় পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী নীতির মুখোশ আর কেউ উন্মোচন করতে সক্ষম হয়নি। আফগানিস্তানে তালেবানদের ফিরিয়ে আনা এবং আফগানিস্তান থেকে উক্ত দখলদার গোষ্ঠীর তিন দশকের জুলুমের লজ্জাকর পরাজয়ের প্রধান কারিগর ইমরান খান। ওআইসিতে যখন পাশ্চাত্যের সেবাদাস আরব শাসকরা কাশ্মীর ও ফিলিস্তিন নিয়ে নীরব থেকেছেন, ইমরান খান সেখানে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন। ইমরান খান ইরানের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, চায়নাকে পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে বড় ভুমিকা রাখার সুযোগ করে দিয়েছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়া- এসবই ইমরান খানের দোষ!

এর আগে যারাই মুসলিম ভাতৃত্বের ও মুসলিম জাতীয়তাবোধের কথা বলেছেন তাদের সকলের পরিণতি এরকম হয়েছে। মিশরের মুরসিকে সেনা অভ্যুত্থানে উৎখাত হয়ে কারাগারে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, টার্কিতে এরদোগান ভাগ্যক্রমে টিকে গেলেও বিপদ তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে, এবার ইমরান খান গেলেন। বাইডেন ক্ষমতায় এসে তার সরকারের মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা সোচ্চার গলায় বলেছিলেন। এটাই মার্কিন সরকারের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের নমুনা। একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে দেয়া। হয়তো তারা বলতে পারেন, গণতান্ত্রিক কায়দায়ই সেটা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি ডিপ স্টেট এই রদবদলে যে বিরাট ভূমিকা রেখেছে, সে কথা কারো চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন নেই।

তবে এই কাজ আমেরিকা নিজে এসে হাতে ধরিয়ে করেনি। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে এই রদবদলের প্রধান কারিগর। পাকিস্তান জাতির দুর্ভাগ্য যে, এরকম একজন সৎ, ভিশনারি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বকে তারা ধরে রাখতে পারেনি। মুসলিম জাতির দুর্ভাগ্য, মুসলমানরা কখনোই তাদের বীর সন্তানের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে মুসলিম বিশ্বে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গড়ে ওঠে না। পাকিস্তানি জনগণের মত সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জনগণ পিপিপি ও মুসলিম লীগের শাসন দেখেছে। তাদের নীতি ও তাদের বন্ধু কারো অজানা নয়। আরেকজন মাওলানা ফজলুর রহমান, যার বিরুদ্ধে শুধু পাকিস্তানের নয়, উপমহাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের প্রবল অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের সাথে এই মওলানা ফজলুর রহমানের বিশেষ খাতির ছিল। জেএমবিকে পাকিস্তান থেকে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে তার ভূমিকা ছিল। ইমরান এর বিরুদ্ধে এই মওলানার ভূমিকা আবারো প্রমাণ করে দিল, নামের আগে মাওলানা, মাথায় পাগড়ি ও মুখভর্তি দাড়ি থাকলেই তিনি ইসলামের সেবক হয়ে যান না।

পার্লামেন্টে মাত্র দুই ভোটের ব্যবধানে ইমরান খান সরকারের পতন একথা প্রমান করে, তিনি এখনও যথেষ্ট জনপ্রিয়। আসন্ন জগাখিচুড়ি সরকারের নীতি ও আদর্শ গত মতপার্থক্যের কারণে এবং পাকিস্তানের বর্তমান আর্থিক দুর্দশার দিকে চোখ রেখে আসন্ন খিচুড়ি সরকারের স্থায়িত্ব ও সাফল্য নিয়ে সংশয় উড়িয়ে দেয়া যায় না। সে কারণেই আমার বিশ্বাস ইমরান খান সরকারের আপাত পতন ঘটলেও আগামী নির্বাচনে তারা আরো ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে।

তার এই পোস্টের বিরোধিতা করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে খোমেনি এহসান নামের এক সাবেক সাংবাদিক লিখেন, কারো যদি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে তার কাজ হলো বিরোধী দলে যাওয়া এবং পরবর্তী নির্বাচনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা। সংসদীয় গণতন্ত্রে এত গালগপ্পোর জায়গা নাই। ইমরান সংখ্যালঘু হলেও তাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে এই আবদার যত আবেগ দিয়েই করেন না কেন এটি অরাজনৈতিক আচরণ। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের লোকদের চিন্তা ভাবনার ফারাক এটিই, বাস্তবতাকে আবেগ দিয়ে আড়াল করার নির্লজ্জ চেষ্টা।

ইস্রাফিল আজাদ নামের একজন লিখেছেন, পশ্চিমাদের গোলামী না করার জন্য আপনাকে স্যালুট খান বাহাদুর, আপনার সুসাস্থ কামনা করছি।

নায়েব আলী নামের এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লিখেছেন, এই পৃথিবীতে পাকিস্তান এমন একটি দেশ, যে দেশ স্বাধীনের পর কোনও সরকারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে নাই। মনে করেছিলাম ইমরান খান পারবেন কিন্তু না। এরপরও সে দেশে তো আস্থা-অনাস্থার একটা ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশে তো তাও নেই। যে ক্ষমতায় যায় সেই বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে।

রাসেল আহমেদ তপু নামের একজনের মন্তব্য, দুঃখজনক। পাকিস্তানে দীর্ঘমেয়াদী সরকার গঠিত হলে সার্বিক উন্নয়ন এবং জিডিপি বৃদ্ধি পাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠত হতো এবং সেনা নির্ভরতা কমে আসতো। ইমরান খানের উচিত ছিলো ক্ষমতায় বসেই সংবিধান সংশোধন করা। এমন অনাস্থা ভোটে ইমরাখানের পরাজয় পাকিস্তানের জনগনের পরাজয়।

মো. আমিনুর রহমান আকাশ নামের একজন লিখেন, আসা করি আগামী নির্বাচনে ইমরান খান একাই ১৭২ আসনের বেশি পেয়ে নির্বাচিত হবে, তখোন আর অনাস্থা ভোটে কাজ হবে না, এবারতো জোট গত ভাবে সরকার গঠন করেছিল, জোটের সদস্যরা বিরোধীদের সাথে যোগ দেওয়াই ইমরান খানের ক্ষমতা চলে গেল, যেটা খুবই দুঃখজনক, ভালো মানুষের কোন মুল্যায়ন হয় না, সব চোরেরা এক হয়েছে।

ড. মিয়াজি আব্দুল বাতেন নামের একজন একটি নিউজের কমেন্টে লিখেছেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে একজন দুর্নীতিমুক্ত নেতা। ভালো মানুষের অবমূল্যায়ন এভাবেই হয়! দুর্নীতিমুক্ত একজন নেতার বিরুদ্ধে সব চোরেরা একজোট হয়েছে!

মো. আজহারুল ইসলাম নামের একজনের মত, আমি মনে করি পাক-জাতির জন্য এটি একটি কালো রাত ছিল। এটার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ হল যে, তারা বিদেশি প্রভুত্বের কাছে এখনো নতশির। পাকিস্তান একজন যোগ্য শাসক হারাল।তবে হ্যাঁ, পাকিস্তানের গণতন্ত্রের প্রখরতা আবার প্রমাণিত হল।

সাব্বির আহমেদ নামের একজন বলছেন, ইমরান খান ছিলেন পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে দেশটির নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীও তাঁদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না। আলহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল তাদের ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করে সুস্থভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কোনো নজির নাই। আমরা এত ভালো দেশ পরিচালনা করি যে অন্য কেউকে আর তার যোগ্য মনেহয় না। পাকিস্তানে আমাদের সরকার প্রধান দায়িত্ব পেলে এই অনাস্থা ভোটের সিস্টেম কবেই তুলে দিতো।

এভাবে অনেকেই বিষয়টিকে নানাভাবে মূল্যায়ন করছেন। তবে এটিকে অধিকাংশ বাংলাদেশি, যারা শোস্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, তারা ইমরান খানের বিরুদ্ধ এ অনাস্থা ভোট ও তার প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না, বলছেন ষড়যন্ত্র।