দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংসদ সদস্যরা আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্র ও এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোকে নারী ও শিশুসহ ২০০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী বহনকারী একটি নৌকাকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করার আহ্বান জানিয়েছেন। যেটি প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের উপকূলে ভেসে বেড়াচ্ছে বলে জানা গেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) অনুযায়ী, নভেম্বরের শেষের দিক থেকে নৌকাটি গভীর সাগরে পাড়ি জমায় এবং যাত্রার পর থেকে জাহাজে থাকা কয়েক ডজন লোক ইতোমধ্যেই মারা গেছে। অন্যদিকে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের খাবার, পানীয় জল বা ওষুধ নেই।
আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের (এপিএইচআর) বোর্ড সদস্য ইভা সুন্দরী বলেন, আমরা জরুরি ভিত্তিতে আসিয়ান সদস্য দেশ ও এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোকে তাদের মানবিক বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে এবং তাদের যথাযথভাবে অবতরণ করার অনুমতি দিয়ে নৌকাটি তাদের জল সীমায় প্রবেশ করলে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান শুরু করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, এটা লজ্জাজনক যে গুরুতর বিপদে পুরুষ, নারী ও শিশুদের নিয়ে নৌকাটিকে ভেসে থাকতে হচ্ছে। ওই মানুষগুলোকে অবহেলা করা মানবতার অবমাননার কম কিছু নয়।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহনকারী আরও দুটি নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে।
এদিকে, ১৫৪ শরণার্থী বহনকারী একটি নৌকাকে ৮ ডিসেম্বর ভিয়েতনামের একটি তেলবাহী জাহাজ উদ্ধার করে। তাদের মিয়ানমার নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১০৪ শরণার্থী বহনকারী আরেকটি নৌকাকে ১৮ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী উদ্ধার করে এবং তাদেরকে কানকেসান্তুরাই হারবারে অবতরণ করা হয়। রোহিঙ্গারা তাদের স্বদেশ মিয়ানমারে কয়েক দশক ধরে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে কর্তৃপক্ষ তাদের অধিকাংশকে রাষ্ট্রহীন করে দেয় এবং সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে সবচেয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় তারা। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে নৃশংস সামরিক অভিযানের শিকার হয়ে প্রতিবেশি বাংলাদেশে সাত লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়। এজন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের অনেকেই উন্নত জীবন খোঁজার জন্য অসাধু মানব পাচারকারীদের হাতে আত্মসমর্পণ করে আন্দামান সাগরের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক পথে মালয়েশিয়ার মতো দেশে পাড়ি জমায়।
এপিএইচআর-এর চেয়ারপারসন ও মালয়েশিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য চার্লস সান্টিয়াগো বলেন, ‘সব সম্ভাবনা বিচারে এসব নৌকা উদ্ধারে বিলম্বের কারণে ইতোমধ্যেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও প্রাণহানি ঘটেছে। আর কোনো বিলম্ব অযৌক্তিক। সাগরে আটকে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি এই অবহেলা নতুন কিছু নয়। যেমনটি বছরের পর বছর ধরে চলছে এবং এর ফলে শত শত, এমনকি হাজার হাজার মৃত্যু হয়েছে। যা সহজেই প্রতিহত করা যেত যদি এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রাথমিক মানবিক নীতিগুলি পূরণ করত।’
এপিএইচআর আসিয়ানকে সমুদ্রে আটকা পড়া শরণার্থীদের ইস্যুতে একটি বিস্তৃত ও সমন্বিত আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করার লক্ষ্যে কার্যকরভাবে কাজ করা ও মানবিক নীতি অনুসারে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সমুদ্রে জীবন বাঁচানোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছে।
মঙ্গলবার এপিএইচআর জানায় যে আসিয়ানের উচিত রোহিঙ্গাদের এত বছর ধরে এই ট্র্যাজেডির মূল কারণগুলোরও সমাধান করা। যার মধ্যে রয়েছে- মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করা এবং বর্তমানে বাংলাদেশের ক্যাম্পে বসবাসকারী শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়া।
রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অপরাধীদের জবাবদিহি করতেও আসিয়ানকে সহায়তা করা উচিত, বিশেষ করে এখন যে সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে গণহত্যামূলক সামরিক অভিযান শুরু করে,তারাই ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একটি অবৈধ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মিয়ানমারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে।
এপিএইচআর বোর্ডের সদস্য ও প্রাক্তন থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাসিত পিরোম্যা বলেন, ‘বহু বছর ধরে আসিয়ান ও বৃহত্তরভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘ সময় ধরে নির্বিকার রয়েছে, কারণ রোহিঙ্গা ট্রাজেডি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। যেসব দেশ মানবাধিকার রক্ষার দাবি করে, তাদের রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সংকটের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে; নতুবা এই মানবিক ট্রাজেডিগুলো বারবার পুনরাবৃত্তি হবে।
সেই সঙ্গে আসিয়ান সদস্য দেশগুলো এই অঞ্চলে ও এর বাইরেও তাদের অংশীদারদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করবে, সমস্ত বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটাবে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনবে।’