একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন ফয়সাল রহমান। দুপুরে অফিসের পাশে একটি হোটেলে নিয়মিত খান তিনি। ৪ মাস আগেও প্রায় প্রতিদিনই খাবারে মাছ অথবা মাংস রাখতেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। বিকল্প খুঁজে প্রথমে সপ্তাহে ৫ দিন খেয়েছেন মাছ-মাংস, এরপর ৩ দিন আর এখন সপ্তাহে একদিন। বাকি দিন চালিয়ে নিচ্ছেন ভর্তা-ভাজি দিয়েই।
বছরখানেক হলো লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করছেন সাইফুর। যে বেতন পান তাতে আগে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করতে পারলেও গত কয়েকমাস যাবৎ টান পড়ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে উপয়ান্তর না দেখে খাদ্যতালিকায় করেছেন কাটছাট।
অনেকে আবার বাদ দিয়েছেন সকালের খাওয়া। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষায় একেবারে খাচ্ছেন দুপুরে।
জীবনযাত্রায় খাদ্যাভাস পরিবর্তনের এ গল্প শুধু ফয়সাল বা সাইফুরের নয়; ঘরে ঘরেই এখন এক চিত্র। মূল্যস্ফীতির কারণে কমেছে ভালো খাওয়া। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় সামঞ্জস্য রক্ষায় মানুষ ঝুঁকছেন বিকল্প খাবারে। মধ্যবিত্তরা হচ্ছেন রেস্টুরেন্ট বিমুখ। সেখানে বসে পরিবার বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিয়ে বেছে নিচ্ছেন খোলা জায়গা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেস্টেুরেন্ট ব্যবসায় আয় কমেছে প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির ধকল সামলাতে না পেরে অনেক ব্যবসায়ী বাধ্য হয়েছেন ব্যবসা বন্ধ করতে।
ধরাশায়ী সাধারণ মানুষ
আগে যাদের কাছে ভালো খাবার মানেই ছিলো রেস্টুরেন্টের কাচ্চি বিরিয়ানি। তারা এখন খাচ্ছেন ডিম খিচুড়ি। রেস্টেুরেন্টগুলোতে খাবারের দাম চড়া। আগে একটি বাফেট লাঞ্চ ছিলো ৪৫০-৫০০টাকা এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ৭৫০ থেকে ৮০০টাকা। নিরুপায় মানুষ খুঁজছেন কোথায় গেলে একটু কম টাকায় মিলবে খাবার। মুরগী-ভাত রাস্তার পাশের হোটেলে ১০০টাকা। একটু গলির ভেতরে গেলে সেটি ৭০টাকা। এভাবে বিকল্প খুঁজে চলছে জীবন।
গণমাধ্যমকর্মী রায়হান রনি বলেন, ‘আগে যে বেতন পেতাম তার প্রায় পুরোটাই খরচ করতাম। কিন্তু এখন টাকা সঞ্চয় করছি। আগে যে খাবার ৪০ টাকায় কিনতাম এখন সেটি ৮০ টাকায় কিনছি। ন্যূণতম খরচ করে যে সুবিধা ভোগ করা সম্ভব সেটি করছি। ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রেস্টুরেন্টে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’
কাজী মাহবুব বলেন, খাবারের মূল্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আগে রেস্টুরেন্টে মাসে ২ থেকে ৩ বার খেতাম। আর এখন দৈনন্দিন খাবার যোগাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
একই কথা জানান গৃহিণী আয়েশা আক্তার। আগে সপ্তাহে বাসায় একদিন পোলাও রান্না করলেও এখন মাসে একদিন করছেন। মাছ-মাংসের জায়গায় ডিম দিয়ে পরিবারের আমিষের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছেন এ গৃহিণী।
কী বলছেন ব্যবসায়ীরা?
মারজানা ইসলাম মেধা। মেধা’স ফুড কর্নার নামে অনলাইনে তার একটি খাবারের পেজ রয়েছে। ফুড ক্যাটারিং ব্যবসার সাথে জড়িত এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাবারের বিক্রি ৩০ শতাংশ কমে গেছে। মূল্যবৃদ্ধির সাথে যেমন খাবারের অর্ডার কমেছে তেমন দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির জন্য খাবারের মূল্য নির্ধারণ করতে যেয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি এভাবে চলমান থাকলে আমাদের খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করা ছাড়া উপায় নেই। ছোট উদ্যোক্তাদের বিশাল আকারের সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। অনেক ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট বন্ধের পর্যায়ে চলে গেছে।’
এ কথার সাথে সুর মিলিয়ে ধানমন্ডি ঝিগাতলা ব্র্যাঞ্চের ক্যাফে রিও রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আবু তালিব দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘আমাদের গ্রাহক হারিয়েছে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে আগে যে পণ্যটি আমরা ১০ টাকায় কিনতাম এখন সেটি ৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের খাবারের মূল্য বাড়াতে হচ্ছে।’
মানুষ রেস্টুরেন্টবিমুখ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে মানুষগুলো আগে রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো তারা এখন খরচ বাঁচাতে বাড়িতেই আয়োজন করছে। আবার রেস্টুরেন্টে আগে ১০০ জন নিয়ে যারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো তারা এখন সীমিত পরিসরে ৩০ জনকে নিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করছে। আজ বাজার খরচ ১০ হাজার টাকা হলে দুইদিনের ব্যবধানেই দেখা যাচ্ছে বাজার খরচ ১১ হাজার টাকা হয়ে যাচ্ছে। ফলে বলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে সপ্তাহ ব্যবধানে একই টাকায় একই পরিমাণ সেবা আমরা দিতে পারবো কিনা।’
বাসায় রান্না করা খাবার পৌঁছে দেন আরেক উদ্যোক্তা রুবাইদা রাখী। তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমার ব্যবসাটা রান্না করা খাবার সেহেতু সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশ অসুবিধায় পড়ে গেছি । তেল, লবণ, চিনি, মসলা, চাল, সবজি, মাছ-মাংস সবকিছুরই দাম আগের চেয়ে অনেক চড়া। সেক্ষেত্রে দাম অনেক বেড়ে গেলেও খাবারের দাম সে অনুযায়ী বাড়াতে পারিনি। বাজার দর বেড়ে যাওয়ায় অনেক গ্রাহকই আর স্বাচ্ছন্দ্যে আগের মত অর্ডার করছেন না। অর্ডার করলেও খাবারের আইটেম বা পরিমাণ অনেক কমে আসছে।’
টিসিবির মাধ্যমে পণ্য চান ব্যবসায়ী নেতারা
উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ধস নেমেছে ব্যবসায়। গ্রাহকদের সংখ্যা অনেক না কমলেও তাদের কেনার ক্ষমতা কমে গেছে। আগে যে গ্রাহক মাছ-মাংস ছাড়া খাবার খেতো না এখন সে সবজি-ডাল দিয়েই খেয়ে চলে যাচ্ছে। কমেছে বাড়তি নেয়ার প্রবণতা।
এ বিষয়ে রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসেসিয়েশন (বিআরওএ)-এর সেক্রেটারি জেনারেল ইমরান হাসান দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘আমাদের বিক্রি প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। আগে যারা প্রতি সপ্তাহে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসতো তারা এখন মাসে একবারও আসছে না। ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের গ্রাহকদের একটি বড় অংশ ছিলো। তারাও এখন আসতে পারছে না। বহু ব্যবসায়ী পথে বসে গেছে। আমি নিজেই আমার দুটো রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। আমরা যে মূলে পণ্য ক্রয় করছি সবকিছু শেষে হিসেব করে দেখছি আমাদের লাভের খাতায় কিছুই থাকছে না।’
সরকারের কাছে সহায়তা চেয়ে এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের পণ্য দিলে আমরা কিছুটা হলেও বাঁচতে পারবো। এছাড়া জরুরী ভিত্তিতে এ ব্যবসাকে শিল্পের মর্যাদা দিলে কিছুটা হলেও সুযোগ-সুবিধা বাড়বে।’
এছাড়া স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আয় কমেছে ১০ শতাংশ
মূল্যস্ফীতির কারণে সবার আয় প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন বৈশ্বিক সমস্যা। এটা শুধু বাংলাদেশ নয় আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ভারত সবাই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে’।
তবে এই মূল্যস্ফীতির ফলাফল শ্রেণিভেদে ভিন্ন। যারা উচ্চবিত্ত শ্রেণি তাদের আয় অনেক বেশি। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ায় তাদের জীবনমানে কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে তাদের আয়ের যে অংশ উদ্বৃত্ত থাকতো সেখান থেকে কিছুটা কমছে।
যারা মধ্যবিত্ত তারা এখন বিকল্প খুঁজছে। মাংস না খেয়ে অন্য কী খাওয়া যায় ভাবছে। এক্ষেত্রে তাদের খাদ্যমান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
দরিদ্র যারা তারা প্রতিবেলা খাদ্যের যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সবকিছুর দাম বাড়লেও আয় না বাড়ায় তাদের কাজের মজুরি কমে যাচ্ছে। আর মজুরি না বাড়ায় তারা বিকল্প দিয়েও জীবন-যাপন করতে পারছে না। এর ফলে মানুষ শহরে টিকতে না পেরে গ্রামমুখী হবে বলেও মন্তব্য করেন এ বিশেষজ্ঞ।
আরও পড়ুন- মূল্যস্ফীতি: শখের পণ্যে বিমুখ ক্রেতা