সময়টা ২০২০। করোনার ভয়াল থাবায় গ্রাস সারা বিশ্ব। বাংলাদেশেও প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা ৩ সহস্রাধিক। গৃহবন্দী মানুষ। মাঠে শুধু জরুরী সেবায় নিয়োজিতরা। ঠিক সেসময় ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে ঘরে ঘরে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দিয়েছেন ‘হাইজিন আপা’।
নাম তার তানিয়া আক্তার। ২২ বছরের এই তরুণীকে ভালবেসে নারীরা নাম দিয়েছেন ‘হাইজিন আপা’। তানিয়ার দেখা মেলে খুলনার ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের জামাল রাইস মিলে। শুধু ওই রাইস মিলটি-ই নয়; আরও ৫ রাইস মিলের নারীদের ভরসার নাম তানিয়া।
কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও ভ্যানে চড়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে ছুটে চলেন তানিয়া। মুঠোফোনে কল এলেই প্যাড নিয়ে হাজির হন।
তানিয়া জানান; প্রতি মাসে গড়ে ১২০ প্যাকেট প্যাড বিক্রি করেন। গত ৩ বছরে বিক্রি করেছেন প্রায় ৪ হাজার ৩২০ প্যাকেট। কোনো কোনো মাসে গড়ে ১৫০ প্যাকেট প্যাডও বিক্রি হয়। দোকান থেকে ৩৩টাকায় কিনে প্রতি প্যাকেট বিক্রি করেন ৪০টাকায়। শুধু প্যাকেট-ই নয় প্রয়োজনে একটি প্যাডও মেলে তানিয়ার কাছে।
আরও পড়ুন- ‘টয়লেটের বেগ পেলেই স্কুল ফেলে ছুটতে হত বাড়ি’
লাভের এই স্বল্প টাকা তানিয়া তুলে দেন মায়ের হাতে। দুই বোন এক ভাই নিয়ে তানিয়াদের সংসার। ওয়াটারএইডের ‘ওয়াশ ফোর আরবান পুওর’ প্রকল্পে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন তিনি।
এ উদ্যোগের পেছনের কারণ কী জানতে চাওয়া হলে তানিয়া বলেন, “করোনার সময় ‘নবলোক’ থেকে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেসময় আমি মাইকিং করতাম। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বোঝাতাম। বার বার হাত ধোয়া, বিশুদ্ধ পানি পান, রান্নায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার, নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুফল, পুরনো কাপড় ব্যবহারে স্বাস্থঝুঁকি, মাসিককালীন খাদ্যাভাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নিয়মাবলী শেখাতাম। তখন নারীরা আমাকে জানান; দোকানে গিয়ে প্যাড কিনতে পারবেন না। তাদের লজ্জা লাগে। একথা শুনে আমার মনে হল প্যাড কিনে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেব। সেই থেকে শুরু। এখন কারো প্যাড লাগলেই আমাকে ফোন করেন।”
তানিয়া জানান; প্রতিটি রাইস মিলে নারী আছেন গড়ে ৭০ জন। ৬ রাইস মিলের বেশিরভাগ নারী প্যাড কেনেন তানিয়ার কাছ থেকে।
আরও পড়ুন- চরে কৃষি কাজে এগিয়ে নারীরা
রাইস মিলের বাসিন্দা শেফালী বেগম বলেন, “২৪ বছরের জীবনে আগে প্যাড কী চিনতাম না। ছোট থেকেই কাপড় ব্যবহার করতাম। ‘হাইজিন আপা’ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে প্যাড ব্যবহার করতে হবে, পুরনো কাপড় ব্যবহার করলে কী ধরনের অসুখ হতে পারে, প্রথম ঋতুকালীন সময়ে কী কী খাবার খেতে হবে, কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।”
আরেক গৃহবধূ সোনিয়া বলেন, “আমাদের মায়েরা মাসিক হলে ঘরের বইরে যেতে দিত না। মাছ-মাংস খেতে দিত না। শুধু আলু ভর্তা আর সবজি দিয়ে ভাত খেতাম। স্কুলে যাওয়া নিষেধ ছিল। কিন্তু এখন আমরা মা-বাবা হিসেবে অনেক সচেতন। হাইজিন আপার মাধ্যমে আমরা ভালো-মন্দ অনেক বিষয় শিখেছি।”
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় খুলনার কয়রা উপজেলা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে মা ও দুই ভাই-বোনের সাথে খুলনা সদরে আসেন তানিয়া। তানিয়ার মা’ও রাইস মিলে কাজ করেন। এই তরুণী স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যতে নারীদের স্বাস্থ্যগত সুরক্ষায় আরও বড় পরিসরে কাজ করার। সুন্দর ও নিরাপদ সমাজ গড়তে সুস্থ নারীর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তানিয়া।
আরও পড়ুন- মাসিক নিয়ে অকপটে কথা বলেন তারা