প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

মানুষের মল-মূত্র থেকে ‘মূল্যবান সার’

আফরিন আপ্পি, সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে ফিরে
১৪ মার্চ ২০২৩ ২১:০৫:২১ | আপডেট: ২ years আগে
মানুষের মল-মূত্র থেকে ‘মূল্যবান সার’

সারা বিশ্ব যখন বর্জ্য নিয়ে চিন্তিত তখন পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুখবর দিচ্ছে নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভা। সেখানে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপন করে মানববর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে মূল্যবান জৈব সার। এ প্ল্যান্ট থেকে প্রতিবছর উৎপাদিত হবে প্রায় ৩৭৯ মেট্রিক টন সার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর ফলে দূষণ থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ, রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমবে, তৈরি হবে কর্মসংস্থান।

সাড়ে ৭কেটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্ল্যান্টে গেলবছর উৎপাদন হয়েছে ১৫ মেট্রিক টন সার। এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০ মেট্রিক টন।

শুধু সৈয়দপুরই নয় টাঙ্গাইলের সখীপুরেও মানববর্জ্য থেকে জৈব উপাদানসমৃদ্ধ সার তৈরি হচ্ছে।  সার তৈরির এ পদ্ধতি দেশের অন্য পৌরসভা ও সিটি  কর্পোরেশনের  জন্য অনুকরণীয় হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সমন্বিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে সৈয়দপুর পৌরসভা ওয়াটার এইড বাংলাদেশের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের কাজ শুরু করে। ২০২১ সাল থেকে সেখানে পয়ঃবর্জ্য শোধন শুরু হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডের পাড়া-মহল্লার বাড়িগুলো থেকে ভেকুট্যাগ এর মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংক থেকে মানববর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পয়ঃবর্জ্য খালি করতে পৌরসভায় লিখিত আবেদন জমা দিলেই বাসার সামনে চলে যায় বিশাল ট্যাঙ্কিসহ গাড়ি।

৩৩ হাজার পরিবার ও ৬টি হাট-বাজারের মানববর্জ্য সংগ্রহ করা হয় এ গাড়িগুলোর মাধ্যমে। এরপর সেগুলো নেয়া হয় শহরের সুরকী এলাকার শোধনাগারে। ১.৭ একর জমির উপর গড়ে ওঠা প্ল্যান্টে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় মানববর্জ্যের সঙ্গে কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে প্রায় পাঁচ ধাপে তৈরী করা হয় সার।  এতে সময় লাগে প্রায় ১২ সপ্তাহ।

বর্তমানে এ জৈব সার বিক্রি করা হচ্ছে কেজি প্রতি ১৫ টাকা দরে। ফলে দিন দিন বাড়ছে এর চাহিদা।

কৃষকরা জমিতে ব্যবহার করছেন এ সার। তেমনই একজন সৈয়দপুরের কামারপুকুর এলাকার আহসানুল হক। ৫০ শতাংশ জমিতে ড্রাগন চাষ করছেন এ কৃষক। এ পর্যন্ত মানববর্জ্য থেকে তৈরি সার কিনেছেন প্রায় আড়াই টন। সার ব্যবহারের সুফল তুলে ধরে তিনি বলেন, “আগে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করতাম। গত বছরের আগস্ট থেকে সৈয়দপুরে মানুষের বর্জ্য থেকে যে সার তৈরি হচ্ছে সেটি ব্যবহার শুরু করেছি। এ সার ব্যবহারের পর আমার জমির গাছগুলো গাঢ় সবুজ হয়েছে। এটি ব্যবহারে মাটির যে জৈব অংশ সেটি আবার ফিরে আসবে বলে আশা করছি।”

ওয়াটার এইডের প্রোগ্রাম অফিসার ইঞ্জিনিয়ার মো. শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, “সৈয়দপুর শহরকে নিরাপদ স্যানিটেশনের আওতায় আনতে পৌরবাসীর কঠিন বর্জ্য ও মল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি এ কাজে  সৈয়দপুর পৌরসভাকে কারিগরি সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সারাদেশে সৈয়দপুর ও সখীপুর এক্ষেত্রে মডেল হতে পারে। ”

কর্তৃপক্ষ জানান, সৈয়দপুরে প্রতি মাসে সংগ্রহ হয় প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার লিটার বর্জ্য। পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহ বাবদ প্রতিবার বড় গাড়ির জন্য গুণতে হয় ৩ হাজার টাকা আর ছোট গাড়ির জন্য ২ হাজার। এ ব্যবস্থাপনায় খুশি স্থানীয়রা।  সেখানের বাসিন্দা মশিউর রহমান বলেন, “আগে আমরা সুইপার ডেকে পরিষ্কার করাতাম। তখন গর্ত খুঁড়ে ময়লা ফেলা হত। পরিবেশ নষ্ট হত। দুর্গন্ধ ছড়াত। যারা আসত অনেক টাকা দাবি করত। অনেক সময় বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি হত। কিন্তু এখন আমরা বছরে দু’বার বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্কি পরিষ্কার করাই। এর ফলে আমাদের খরচ অনেক কমেছে।”

এ বিষয়ে সৈয়দপুরের  জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, “সৈয়দপুরে বর্তমানে এটি সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে এ ব্যবস্থাপনা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে সাধারণ মানুষ এর উপকার উপলব্ধি করতে পারবে। এছাড়া এ পদ্ধতিতে সার তৈরির ফলে রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা কমে জৈব সারের ব্যবহার বাড়বে। পাশাপাশি অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।”

এ সার ব্যবহারে মাঠপর্যায়ে সচেতনতামূলক কাজ করছে সমাজ কল্যাণ সংস্থা (এসকেএস) ফাউন্ডেশন। সংস্থার প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর নজরুল ইসলাম তপাদার বলেন, এই সার সৈয়দপুরের ১৩২টি পারিবারিক পুষ্টিবাগান ও ৭৪ জন কৃষক ব্যবহার করছেন। এখন পর্যন্ত ৩৫ টন সার উৎপাদন হয়েছে এর মধ্যে বিক্রি হয়েছে ২৯ টন।

সৈয়দপুর পৌর মেয়র রাফিকা আক্তার জাহান বলেন, “সৈয়দপুরে পয়ঃবর্জ্য থেকে যে সার উৎপাদন হচ্ছে এ থেকে আমরা রাজস্ব পাচ্ছি। এটিকে কীভাবে আরও বেশি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায় সে লক্ষ্যে আমরা পাড়া মহল্লায় প্রচার প্রচারণা ও বাজার মনিটরিং শুরু করেছি। দিন দিন এ সারের চাহিদা বাড়ছে।  ভবিষ্যতে আমরা আরও বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা করছি। “

এ বিষয়ে  সৈয়দপুরের অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মমতা সাহা বিজনেস পোস্টে’কে বলেন, “আমরা এই সার ব্যবহার করেছি আমাদের পুষ্টি বাগানগুলাতে। এ সার ব্যবহার করে উৎপাদিত সবজি ফলমূল খেয়েছি। ফলন দেখে বেশ ভালো মনে হয়েছে।”

রংপুর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ল্যাব টেস্টে নিরাপদ ছাড়পত্র পেয়েছে এ সার। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আইয়ুব-উর-রহমান স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারের বেঁধে দেয়া নির্দেশনায় নিরাপদ ছাড়পত্র পেতে যে সকল উপাদান যে পরিমাণে থাকা প্রয়োজন তার সবগুলো যথাযথ মাত্রায় উপস্থিত এ জৈব সারে।

 আরও পড়ুন- 

‘টয়লেটের বেগ পেলেই স্কুল ফেলে ছুটতে হত বাড়ি’

মুঠোফোনে কল এলেই স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেন তানিয়া

মাসিক নিয়ে অকপটে কথা বলেন তারা

চরে কৃষি কাজে এগিয়ে নারীরা